
একুশ বছর বয়সী কুষ্টিয়ার মো. তানজির শেখকে এখন তাড়া করে ফেরে ঋণের বোঝা আর বিভীষিকাময় স্মৃতি।
২০২৩ সালের শেষ দিকে ভালো জীবিকার আসায় লিবিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন তানজির। কিন্তু সেখানে পৌঁছে মানবপাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দুঃসহ সেই দিন পেরিয়ে দেশে ফিরতে পারলেও চেপে বসেছে ঋণের বোঝা।
তাকে উদ্ধারে জমি ও সারাজীবনের সঞ্চয় ব্যয় করতে হয়েছে তার পরিবারকে। ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেছেন তানজির।
তানজির জানান, লিবিয়ার একটি স্বনামধন্য কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্থানীয় এক দালাল। তাকে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সেই দালালকে দিতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে একটি মাদ্রাসায় কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যেখানে তাকে অনিয়মিতভাবে এত কম বেতন দেওয়া হতো যা দিয়ে টিকে থাকাও কঠিন ছিল।
'আমি রোজ খেতেও পেতাম না,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তানজির। 'তবু আমি নয় মাস ধরে আশায় ছিলাম যে হয়তো পরিস্থিতি বদলাবে। কিন্তু কিছুই বদলায়নি। শেষে আমি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি।'
যখন দালালকে তানজির জানায়, সে আর টিকে থাকতে পারছে না, তখন দালাল তাকে ইতালিতে পাঠানোর জন্য আরও টাকা দাবি করে। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে তার পরিবার এক খণ্ড জমি বিক্রি করে ৭ লাখ টাকা পাঠায়।
কিন্তু তাকে ইউরোপে পাঠানোর পরিবর্তে, ওই দালাল লিবিয়ার মানব পাচারকারীদের সঙ্গে মিলে তানজিরকে একটি স্থানীয় মিলিশিয়া গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই গ্রুপটি তাকে আবার বিক্রি করে দেয়। এবার লিবিয়ায় সক্রিয় একটি বাংলাদেশি চক্রের কাছে বিক্রি করে তারা।
'তারা আমাকে অমানুষিকভাবে মারধর ও নির্যাতন করে,' তানজির বলেন। 'তারা ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। আমি একমাত্র ছেলে ছিলাম। বাবা দ্বিতীয়বার না ভেবে আমাদের বাকি তিন কাঠা জমি বিক্রি করে তাদের টাকা পাঠিয়ে দেন।'
মুক্তি পাওয়ার পর তানজিরকে আরেকজন বাংলাদেশির সঙ্গে একটি প্রত্যন্ত এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে একজন পরিচিতের সাহায্যে তারা দুজনেই উদ্ধার পান। ব্র্যাকের সহযোগিতায় গত ৯ জুলাই তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন – জীবিত, কিন্তু নিঃস্ব অবস্থায়।
'আমরা আমাদের সবকিছু হারিয়েছি – আমাদের জমি, আমাদের সঞ্চয়। যা অবশিষ্ট আছে তা হলো শুধু ঋণ। আমি ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণ চাই,' বলেন তানজির।
স্থানীয় দালাল রফিজুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
তানজিরের গল্প শুধু একটি নয়, এরকম আরও ঘটনা রয়েছে।
নোয়াখালীর ৪৫ বছর বয়সী মো. আলমগীর হোসেনও ২০২২ সালে লিবিয়ায় পাচারের শিকার হয়েছিলেন। দুই বছর পর একটি মিলিশিয়া গ্রুপ তাকে অপহরণ করে এবং পরে এক বাংলাদেশি মানবপাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।
তার পরিবার তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য এর আগে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু তার জীবন বাঁচাতে, মুক্তিপণের টাকা মেটাতে তাদের আরও সাড়ে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিতে হয়।
আলমগীর অবশেষে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইওএম, লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ব্র্যাকের সহায়তায় দেশে ফিরে আসেন।
তার ভাই মানব পাচারকারীদের শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণের দাবিতে এই বছরের জানুয়ারিতে একটি মামলা দায়ের করেন। দুই স্থানীয় দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তবে তারা বর্তমানে জামিনে আছেন।
এরকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মানবপাচার প্রতিরোধ মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে ১০ হাজার ৯১৭টি মানবপাচার মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে ৫ হাজার ৪৫০টি মামলা এখনও বিচারাধীন এবং ৫ হাজার ৪৬৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে -- যা অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কাজনকভাবে কম বলে জানিয়েছেন।
এই সময়কালে, ১৩ হাজার ৪২৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে ৭ হাজার ৫১৭টি মামলার প্রেক্ষিতে। ১০ হাজার ৫৭৯ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১৪ হাজার ৫৮৩ জন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে -- যদিও বেশিরভাগই এখন জামিনে আছেন। মাত্র ২৪৭টি মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে।
শুধু ২০২৩ সালেই ১,৫৮৯টি নতুন মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালেও একই সংখ্যক মামলা হয়েছে। অথচ এই দুই বছরে মাত্র ১০৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এবং মাত্র ৩৪৫ জন পাচারকারী দোষি সাব্যস্ত হয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আরও ৯৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, গত এক দশকে মানবপাচারের ধরন অনেকখানি বদরে গেছে।
'গত তিন বছর ধরে যেসব দেশের নাগরিকরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে রয়েছে,' তিনি জানান।
'অভিবাসনের নামে পাচার চলছে। মামলা দায়ের করা হলেও, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো তাদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে না বলে সেগুলোর সমাধান হচ্ছে না।'
তিনি বলেন, ধীর অগ্রগতির পেছনে মন্ত্রণালয় এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব অন্যতম প্রধান কারণ।
'এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে অভিবাসনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। গন্তব্য দেশগুলো বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান বন্ধ করে দেবে, যা আমাদের অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলবে,' সতর্ক করেন তিনি।
শরণার্থী ও অভিবাসী আন্দোলন গবেষণা ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, পাচার মামলার বিচারের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালের অভাব একটি বড় বাধা।
'এই ধরনের ট্রাইব্যুনাল খুব কম জায়গায় আছে। বেশিরভাগ জেলায় নেই, যার ফলে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়,' বলেন তিনি।
'এছাড়া, অনেক ভিকটিম ও সাক্ষী ভয়ভীতি বা প্রতিশোধের আশঙ্কায় সাক্ষ্য দিতে সাহস পান না। এটাও বিচার বিলম্বের অন্যতম কারণ।'
তিনি সরকারের প্রতি আরও ট্রাইব্যুনাল স্থাপন, সাক্ষী সুরক্ষা কার্যকর করা এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর আহ্বান জানান যাতে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত হয়।