Image description

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছাত্র-জনতার ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গণগ্রেপ্তার, গুম, খুন, হামলা ও মামলার মধ্য দিয়ে যখন সারাদেশে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তখন ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই রাত সোয়া ১১টায় হঠাৎ টেলিগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে একটি বার্তা। বার্তায় জানানো হয়, ৩১ জুলাই দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে অনুষ্ঠিত হবে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’। আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের।

ঘোষণায় বলা হয়, ‘গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, গুম-খুন, মামলা-হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তপূর্বক বিচারের দাবি’ এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। দেশের সমস্ত আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে একযোগে এই কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবীসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের কর্মসূচিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশের আহ্বান জানানো হয়। সরকারকে দাবি মেনে নিয়ে স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়।

তবে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামটি কে প্রস্তাব করেছিলেন, তা নিয়ে অনেকের মাঝে কৌতূহল ছিল। পরবর্তীতে জানা যায়, এই নামের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস-এর ঢাবি রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করা তাওসিফ বর্তমানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে কর্মরত। 

সাংবাদিক তাওসিফুল ইসলাম

তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি এসএম ফরহাদ জানান, বহুল আলোচিত ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ এবং ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির নাম নির্ধারণে সাংবাদিক তাওসিফুল ইসলাম সহযোগিতা করেন। নামগুলো চূড়ান্ত করে যথারীতি প্রেস রিলিজ আকারে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ হয়ে ওঠে গণমিছিল, অসহযোগ আন্দোলন এবং জাতীয় প্রতিবাদের অন্যতম প্রতীক। এই আহ্বানে দেশি প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের লক্ষ্যে পরিচালিত ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা আবু সাদিক কায়েম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৩০ জুলাই আমরা আলোচনা করছিলাম কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। তখন দেশজুড়ে গণহারে গ্রেপ্তার চলছিল এবং একটি ভয়াবহ আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সেই প্রেক্ষাপটে আমরা হাসিনা সরকারের গণহত্যার বিচার ও ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলছিলাম। এই উদ্দেশ্যে আমরা সবাই আদালতে একত্রিত হয়ে দাবি জানাবো বলে ঠিক করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ধারণাটা আমি সাংবাদিক তাওসিফুল ইসলামের সঙ্গে শেয়ার করি এবং তাকে কর্মসূচির একটি নাম প্রস্তাব করতে বলি। তখন তিনি আমাদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’সহ আরও দুটি নাম জানায়। আমরা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামটি বেছে নিই এবং এই নামে কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করি।’

আবু সাদিক কায়েম জানান, ‘পরবর্তীতে ১ আগস্ট কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করি। যেহেতু আগস্ট মাস একটি চেতনার মাস, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, হাসিনা সরকারের গণহত্যার বিষয়গুলো সামনে আনবো, আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরণ করবো, আমাদের হিরোদের সম্মান জানাবো। তখন এই কর্মসূচির নাম কী হবে, তা নিয়ে তাওসিফের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করি। সে আমাদের ‘রিমেম্বারিং দ্য হিরোস’ নামটি দেয়। পরে আমরা সেই নামটিও চূড়ান্ত করে কর্মসূচি পালন করি।’ সাদিক কায়েম আরও জানান, জুলাই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলোর পরিকল্পনা তিনিই দিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে তাওসিফুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ৩০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি আবু সাদিক কায়েম আমাকে ফোন করে বলেন, যেন আমি তার পাঠানো ম্যাসেজ দেখে নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ইনবক্স চেক করি। দেখি, তিনি সারা দেশে আদালত চত্বর ঘেরাও কর্মসূচির একটি খসড়া পাঠিয়েছেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন কর্মসূচির জন্য একটি নাম প্রস্তাব করতে। আমি বললাম, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই নামটি পছন্দ করলেন এবং পরের দিনই কর্মসূচি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি পরদিন দোয়েল চত্বরে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি কভার করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা কর্মসূচি সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা শিক্ষার্থীদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা থেকে রক্ষা করেন। তবে পুলিশ মিছিলের পথ আটকে দেয় এবং শিক্ষার্থীদের হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেয়নি। এ সময় বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়।’

তাওসিফ জানান, ‘সেই দিনই, শিবিরের তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি জেনারেল এসএম ফারহাদ আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি প্রথমেই আমার পূর্ববর্তী কর্মসূচির নামকরণের প্রশংসা করেন। এরপর তিনি আমাকে একটি ভার্চুয়াল কর্মসূচির নাম সাজেস্ট করতে বলেন, যেখানে দেশের মুক্তিকামী মানুষ জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে তাদের স্মৃতি লিখবেন এবং অনলাইনে ছবি শেয়ার করবেন। আমি চারটি নাম প্রস্তাব করি, যার মধ্যে ছিল ‘Remembering Our Heroes’। তিনি বলেন, দু’শব্দের ছোট একটি নাম হলে ভালো হয়। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, সেই রাতেই দেখি আমার প্রস্তাবিত নামটিই ১ আগস্টের ভার্চুয়াল কর্মসূচির জন্য চূড়ান্ত হয়েছে। সেই ইভেন্টটিও সফল হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ঠিক করা, নামকরণ করা, মাঠে আন্দোলন কীভাবে পরিকল্পিতভাবে সফল করা যায়— সেসব বিষয়ে দারুণ ভূমিকা পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা। আমরা সেসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সক্রিয় ছিলাম। অনেক সময় পত্রিকার অফিসে সব লিখতে পারিনি, তাই ফেসবুকে লিখেছি। মানুষ আমাদের টাইমলাইন দেখতো, আমাদের ভরসা করতো। সত্য জানানোর জন্য তখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। নানান মহল, নানান মতের মানুষের সম্মিলিত অবদানের কারণেই আমরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছি।’

রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচী কেবল একটি কর্মসূচি ছিল না, ছিল জাতীয় বিবেকের চেতনাজাগানিয়া ধ্বনি। নিহতদের রক্তে রাজপথ লাল হয়েছে, আর জীবিতদের চোখে উঠেছে এক দহনের প্রশ্ন— এই রাষ্ট্র কি কেবল শোকপালনের মধ্য দিয়েই দায় এড়াবে?