
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের হয়। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর একই বছরের ২৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৩০তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। আগামী ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। এতে জুলাইয়ের দিনগুলোর স্মৃতিচারণের পাশাপাশি তিনি কথা বলছেন ক্যাম্পাসের বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রশাসনের পরিকল্পনা নিয়ে। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরছেন ইন্টার্ন নিশাত তাসনিম জেসিকা—
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: জুলাইয়ের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করবেন...
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান: প্রথমত, ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান—তার এক বছর পূর্তির কাছাকাছি আমরা চলে এসেছি। আমার কাছে এটি রক্তের ঋণ স্বীকার করার একটি উপলক্ষ। অনেক মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমাদের সামনে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে, তবে এর সঙ্গে বড় একটি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমরা তাদের স্মরণ করছি। রক্তের বিনিময় হয় না—শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা রাখা, আর যার যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে আমরা তাদের ঋণ কিছুটা শোধ করতে পারি।
আমি একজন শিক্ষক, আপনারা সাংবাদিক—যে যার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করা, নিজের জায়গা থেকে দেশকে ভালোবেসে দায়িত্ব পালন করা—এটাই আমার কাছে তাদের প্রতি সম্মান জানানোর বড় উপায়। দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার তা হলো, ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই। আমরা সত্যিকার অর্থে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে, রক্তের বিনিময়ে একটি নতুন সুযোগ পেয়েছি। আর এ সুযোগ তৈরি হয়েছিল, কারণ আমরা এক হতে পেরেছিলাম।
সরকারি, প্রাইভেট, আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কৃষক, শ্রমিক, আপামর জনতা—সবাই সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়েছিল। মানুষের ঐক্য থেকেই আমরা ফলাফল পেয়েছি। কিন্তু আজ ঐক্য বিনষ্ট করার নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও চেষ্টা চলছে—এটি আমরা সবাই জানি। তাই এ সময়ে সবচেয়ে দরকার সচেতন থাকা এবং পরস্পরের হাত ধরে রাখা। বিশেষ করে যখন আমরা গণঅভ্যুত্থানের বার্ষিকীর দিকে যাচ্ছি, তখন পরস্পরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার—ঐক্য বিনষ্টের পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে কী উদ্যোগ নিচ্ছে ঢাবি প্রশাসন?
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের মতো করে এ গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি এবং তার যে স্পিরিট, সেটিকে সম্মান জানানোর জন্য অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা অ্যাকাডেমিক গবেষণার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগ একটি গবেষণা প্রকল্প করছে। তাদের গবেষকরা ইতিমধ্যে এখানে এসে ঘুরে গেছেন। আমরা ছয়টি সেমিনার এ বিষয়ে আয়োজন করেছি।
শহীদদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন—যেমন কাপড়-চোপড় বা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আমরা আমাদের সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করেছি। আগামী মাসে ডাকসু ভবনে নতুন সংগ্রহশালাটি আমরা চালু করব। আমাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনা, এ সংগ্রহশালাকে একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘরে রূপান্তর করার। আমরা আহত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি এবং কিছু আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থাও করেছি। সরকারের সঙ্গে একসাথে কাজ করে বড় কিছু উদ্যোগ নিয়েছি।
বিশেষ করে আমাদের কিছু তরুণ ও কিশোরদের কর্মসংস্থানমুখী কাজে একত্রিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া এই বিষয়গুলোকে তাদের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগও নিয়েছি। একটি কারিকুলাম কাউন্সিলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে এবং আইকিউএসির (IQAC) সাথে এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: ডাকসু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে কী ভাবছেন?
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান: গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—ছাত্রদের অধিকার রক্ষার জন্য ডাকসু নির্বাচন। আমরা গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে ডাকসু নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতিমধ্যে রিটার্নিং অফিসার ও চিফ রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। তারা শিগগিরই তফসিল ঘোষণা করবেন।
আমরা চাই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে এর উদ্বোধন করতে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই—এই প্রশাসনের কোনো আলাদা এজেন্ডা নেই। আমরা কাউকে বিশেষ সুবিধা দিতে চাই না। আমাদের কোনো গোপন চিন্তাও নেই। আমরা চাই নেতৃত্বের বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ডাকসু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্রিয় হোক।
অনেক বছর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। এর আগে যে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেখানে ছাত্রদের অনেক অভিযোগ ছিল—বিশেষ করে নিরপেক্ষতার ঘাটতি নিয়ে। আমরা এবারের নির্বাচনের জন্য ধাপে ধাপে স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছি। ১১টি ধাপ আমরা জনসমক্ষে ঘোষণা করেছি। ডিসেম্বর ২৭ তারিখ থেকে কাজ শুরু করে আমরা এখন নবম ধাপে পৌঁছেছি।
তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচন অফিসের কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। ছাত্রদের সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলছি। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গেও কমিশন আলোচনা করছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে একসঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করতে চাই।
সাংবাদিকদের জন্যও আমরা তথ্য সরবরাহ সহজ করতে একজন মুখপাত্র নিয়োগ করব। নিয়মিত আপডেট দেব। যদি কোনো বাধা আসে, তা সবাইকে জানাব। আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে, সবার সহযোগিতা নিয়ে এ কাজটি শেষ করতে চাই। যদিও এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনা, তবুও এর জাতীয় তাৎপর্য রয়েছে। এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রতি সম্মান জানানোর একটি বড় সুযোগ। আমরা ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: নির্বাচন আয়োজন নিয়ে করা প্রশাসনের কমিটিগুলোর কাজ কতটুকু এগিয়েছে?
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমরা সত্যিই চেষ্টা করছি—সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যতটা সম্ভব একসঙ্গে কাজ করতে। আমাদের তিনটি কমিটি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। প্রথম কমিটি আচরণবিধি দেখছে। দ্বিতীয় কমিটি সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে কাজ করছে। তৃতীয় কমিটি সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছে।
এ পর্যন্ত তিনবার সিন্ডিকেটে বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন মতামত পাওয়া গেছে। আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছি। সিন্ডিকেটে আলোচনা করে যতদূর সম্ভব বিষয়গুলো ঠিক করার চেষ্টা করা হয়েছে। কতটুকু ঠিক হয়েছে, কতটুকু হয়নি—তা আপেক্ষিক বিষয়। সবার মতামত নেওয়া সম্ভব নয়, তবে যত বেশি সম্ভব মানুষের মতামত নিয়ে আমরা কাজ করছি।
আপনি কিছু ছাড় দেবেন, আমি কিছু ছাড় দেব—এভাবেই সমঝোতার মাধ্যমে আমরা এগোতে চাই। কমিশন সবার কথা শুনতে চায়। হয়তো সব কথা মানা সম্ভব হবে না, তবে আন্তরিকতার সঙ্গে আমরা এ কাজটি সম্পন্ন করতে চাই।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ কতটুকু এগিয়েছে?
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান: চাইনিজ সরকারের সাথে আমাদের মেয়েদের জন্য একটি নতুন হল নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের ইআরডি (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) মিটিং সম্পন্ন করছে এবং দেশটির দূতাবাসকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে।
এছাড়া প্রায় ২ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্পের আওতায় নয়টি নতুন হল, বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি, আবাসন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোলাবোরেশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এক্সিকিউটিভ কমিটির মিটিং হয়ে গেলে কাজ শুরু হবে। আমরা এসব উদ্যোগকেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে সম্মান জানানোর অংশ হিসেবে দেখি।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান: দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।