
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রতিশ্রুতি থাকলেও কোনোভাবেই সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টন বা পিআর পদ্ধতি চায় না বিএনপি। সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চায় দলটি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আগামী সপ্তাহের সংলাপে দলের পক্ষ থেকে এ অবস্থানই তুলে ধরা হবে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, ঐকমত্য কমিশন যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে উচ্চকক্ষ বাতিলের প্রস্তাব করে, তবে বিএনপি তার বিরোধিতা করবে না। কিন্তু ৩১ দফায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, আগামীতে ক্ষমতায় এলে সেই অঙ্গীকার রক্ষা করা হবে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তির সমন্বয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।
বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হয়। এ সময় সদস্য সংখ্যা ১০০ করার বিষয়েও প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছায় দলগুলো। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে একমত হতে পারেনি। পরে গত সোমবার ঐকমত্য কমিশন ৬৪ জেলা এবং ১২ সিটি করপোরেশন থেকে একজন করে নির্বাচিত সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের বিকল্প প্রস্তাব করলে তা সরাসরি নাকচ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ অধিকাংশ দল। পরদিন কমিশনের সংলাপে বিএনপিসহ পাঁচটি দল প্রস্তাব করে, সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে।
অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপিসহ ২১টি দল ভোটের অনুপাতে (পিআর) উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পক্ষে অবস্থান তুলে ধরে। কয়েকটি দল এমন প্রস্তাবও করেছে, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে উচ্চকক্ষেরই দরকার নেই।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, আমরা আগে যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেই জায়গাতেই আছি। ৩১ দফার ভিত্তিতে আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে যা বলেছিলাম, তা হলো, যারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজন, যাদের জাতি গঠনে অবদান আছে এবং যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তাদের প্রতিনিধি নিয়ে উচ্চকক্ষ হবে। জাতি যাতে সমৃদ্ধ হয়, সেই ভাবনা থেকে আমরা প্রস্তাবটি রেখেছিলাম। সেখানে আমরা উচ্চকক্ষে ১০০টি আসন রাখার জন্য বলেছিলাম।
অন্যদিকে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলো একমত। তবে সংসদের উচ্চকক্ষের মতো নারী সংসদ সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও তারা একমতে পৌঁছাতে পারেনি। কমিশনের প্রথম প্রস্তাব ছিল, সংসদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০০ করা হবে। ১০০ আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে শুধু নারীরা প্রার্থী হবেন। এতে ঐকমত্য না হওয়ায় গত সোমবার কমিশন প্রস্তাব করে, ২৫টির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে– এমন দলগুলো অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থী দেবে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল এ প্রস্তাব নাকচ করে।
বিএনপি আগের মতোই জানায়, নারী আসন ১০০ করতে একমত হলেও নির্বাচন হতে হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে। অর্থাৎ কোনো দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের আসন সংখ্যার অনুপাতে। জামায়াত জানায়, পিআর পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হলে তারা আসন বৃদ্ধিতে রাজি। এনসিপি নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের নতুন ফর্মুলা দেয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংসদে নারী সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। নেতারা জানান, তারা নারীর ক্ষমতায় ও প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসন সংখ্যা ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি নতুন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা ১০০টির মধ্যে ৫০টি নারী আসন সংরক্ষিত চাইবে। আর বাস্তবতার নিরিখে ধাপে ধাপে নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন চাইবে। এর অংশ হিসেবে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৫টি আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনে দ্বিগুণ ৩০টি আসনে সরাসরি নির্বাচন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। দলটি তাদের মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি রয়েছে। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না। স্থায়ী কমিটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।
বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, যদি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্যাপক বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র তেমন অর্থবহ থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে সেটা অকার্যকর হয়ে পড়বে। দলটি মনে করে, আগামীতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কিংবা সংসদীয় সরকার– যে পদ্ধতিই করা হোক, সরকারপ্রধানকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। তা না হলে সরকারের স্থিতিশীলতা কিংবা ভারসাম্য রক্ষা হবে না। তবে আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা নিয়ে আগামীতে আরও আলোচনা হবে।
বৈঠক বিষয়ে গতকাল শুক্রবার সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, যারা পিআর পদ্ধতির নামে বাংলাদেশে নির্বাচনের দাবি তুলছে, তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তারা নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে চায়।