Image description

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গ্যাস–বিদ্যুৎ সংকট ও নীতিগত জটিলতার কারণে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) খাতে যে মন্দাভাব বিরাজ করছিল, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে সেই চিত্রে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসে দেশের নিট এফডিআই ১১৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে মোট এফডিআই এসেছে ১৫৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার, যার মধ্যে ৭১ কোটি ১৫ লাখ ডলার মুনাফা ও ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে দেশ থেকে চলে গেছে। ফলে নিট হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে থেকে গেছে ৮৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের ৪০ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের তুলনায় ১১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। আগের প্রান্তিক অর্থাৎ ২০২৪ সালের অক্টোবর–ডিসেম্বরে নিট এফডিআই ছিল ৪৯ কোটি ডলার।

বিনিয়োগ উৎস ও খাত

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে নিট নতুন ইক্যুইটি বিনিয়োগ এসেছে ২৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের ১২ কোটি ডলারের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। এছাড়া পুনর্বিনিয়োগ আয় থেকে এসেছে ১৯ কোটি ডলার এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণ হিসেবে এসেছে ৪০ কোটি ডলার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এফডিআই প্রবাহ বাড়ার পেছনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ পরিবেশে কিছুটা উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়াগুলোর বাস্তবায়ন গতি পাওয়াকেই মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘এই বছরের এফডিআই আসার পেছনে আমাদের ভূমিকা যৎসামান্য। বিনিয়োগের ডিসিশন আগেই হয়ে ছিল। সম্ভবত প্রসেস একটু গতিশীল হয়েছে।’

এদিকে, সরকার এফডিআই বাড়াতে প্রণোদনা সংক্রান্ত পরামর্শ দিতে পাঁচ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। গত ২৯ মে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আগামী এক মাসের মধ্যে এই কমিটি তাদের মতামত দেবে।

বিদেশি ঋণে স্থিতি ও রিজার্ভ পরিস্থিতি

অন্যদিকে, সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ চলতি বছরের মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১০৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে এই ঋণ ছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ডলার এবং গত বছরের জুন শেষে ছিল ১০ হাজার ৩৪১ কোটি ডলার।

সরকারি খাতে মার্চ শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৪৮৯ কোটি ডলার, আর বেসরকারি খাতে রয়েছে ১ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে নেওয়া উচ্চসুদের বাণিজ্যিক ঋণের তুলনায় বর্তমান সরকার তুলনামূলক কম সুদের আন্তর্জাতিক ঋণে জোর দিচ্ছে। মার্চ মাসে আইএমএফ-এর দুই কিস্তির ১৩৪ কোটি ডলার ছাড় হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবি’সহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে আরও ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।

রিজার্ভে ইতিবাচক প্রবণতা

বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও উন্নতি দেখা যাচ্ছে। জুন শেষে বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তবে জুলাইয়ের শুরুতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) বাবদ ২০২ কোটি ডলার পরিশোধের পর গ্রস রিজার্ভ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম৬ অনুযায়ী ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। উল্লেখযোগ্যভাবে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সময় রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে এটি সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এফডিআই ও বৈদেশিক ঋণ প্রবাহে ইতিবাচকতা বজায় রাখতে হলে সরকারের নীতিনির্ধারণী অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়তে পারে। একইসঙ্গে উচ্চ সুদের বাণিজ্যিক ঋণ পরিহার করে বহুপাক্ষিক উৎস থেকে স্বল্প সুদের ঋণ গ্রহণ দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে সহায়ক হতে পারে।