
গত বছরের ২৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্য নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অন্যদিকে, এ সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখান করে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার আন্দোলনকারীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সরকারের ভূমিকার প্রতিবাদস্বরূপ চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলা ও ফেসবুকে নিজেদের প্রোফাইল পিকচার লাল করার ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। এ লাল কাপড় বাঁধা ও প্রোফাইল লাল করার পরিকল্পনা কার মাথায় এসেছিল বা কে এই কর্মসূচির উদ্যোক্তা ছিলেন, সে বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। আসলে এ কর্মসূচির উদ্যোক্তা কে, সে বিষয়টি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
জানা যায়, গত রবিবার (৬ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ সর্বপ্রথম লাল কাপড় বাঁধা ও লাল প্রোফাইল নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেন। এ সময় তিনি দাবি করেন, তৎকালীন শিবির সভাপতি সাদিক কায়েমের কাছে সর্বপ্রথম ‘সফট কর্মসূচি’ হিসেবে লাল প্রোফাইলের এ কর্মসূচির কথা জানানোর পর তা পরামর্শ করে চূড়ান্ত করা হয়। এরপর ফরহাদের এ দাবির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের। তিনি জানান, লাল কাপড় ও প্রোফাইলের আইডিয়াটা মূলত ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরের। তবে এস এম ফরহাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে তিনি কিছু স্পষ্ট না করলেও এ কর্মসূচি চূড়ান্ত করার সময়ে সাদিক কায়েমের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে বলে জানান। কাদেরের এ বক্তব্যের পর পক্ষ-বিপক্ষ আলোচনা ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ দাবি করেন, লাল কাপড় নয় বরং লাল ভ্যাজ ধারণ করে মিছিলের প্রস্তাবক ছিলেন ছাত্রদলের নাছির উদ্দীন নাছির। পরে সেই আইডিয়া কাজে লাগিয়ে চোখে-মুখে লাল কাপড় বাঁধার প্রস্তাব করেন সমন্বয়ক মাহিন সরকার। অন্যদিকে, ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার ধারণার পেছনে তৎকালীন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কর্মী নুরুল ইসলাম নাহিদের অবদান রয়েছে বলে জানান রিফাত। তবে সংশ্লিষ্ট বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা না হলেও পরে নাহিদের কাছ থেকে আইডিয়া নিয়ে তিনি নিজেই প্রোফাইল লাল করার বিষয়টি প্রস্তাব করেন। এছাড়া, লাল কাপড় বেঁধে ছবি ও প্রোফাইল পিকচারের জন্য হ্যাশট্যাগ শিবিরের ঢাবি সভাপতি সাদিক কায়েম (ছদ্মনাম সাইমুম) দিয়েছেন বলে জানান রিফাত।
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বর্তমানের এনসিপি নেতা মাহিন সরকারও রিফাত রশিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জানান, ছাত্রশক্তির নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম প্রোফাইল লাল করে। তিনি বলেন, ছাত্রশিবির যেই ঘৃণ্য অপরাধ করলো ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করে, সেটা তাদের গাদ্দারিরই ধারাবাহিকতা মাত্র। বিভাজনের প্রথম সূচনা এদের হাত ধরেই হয়েছে।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাবি শাখার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের নীতি নির্ধারণ করার স্বার্থে ঢাবি শিবিরের তৎকালীন সভাপতি সাদিক কায়েম (সুমন কর্মকার ছদ্মনামে) বর্তমানে যিনি কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক, এস এম ফরহাদ (সাজিদ মাহফুজ ছদ্মনামে) এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মহিউদ্দিন খান ‘২০২৪’ নামে একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ পরিচালনা করতেন। সেই গ্রুপে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা সমন্বয়কদেরকে আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে জানাতেন এবং সে অনুযায়ী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করত।
ওই গ্রুপের ২৯ জুলাইয়ের চ্যাটিংয়ের স্ক্রিনশট ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩০ জুলাইয়ের কর্মসূচির জন্য একটি প্রেস রিলিজ সাদিক কায়েম রেডি করে ৮টা ৩০ মিনিটে গ্রুপে পাঠান; যেখানে এদিন চোখে-মুখে কালো কাপড় বাঁধার কথা উল্লেখিত ছিল। সাদিকের এই বার্তার জবাবে ফরহাদ জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাড়িতে বসে থাকবে? কালো কাপড় বেঁধে, নাকি বাইরে?’। তখন সাদিক কায়েম লেখেন, ‘যার যেখানে ইচ্ছে, এরপর লিফলেট বিতরণ। সফট কর্মসূচি’। মহিউদ্দিন লেখেন, ‘এটা অনলাইনে প্রচারের বিষয়টা কি উল্লেখ করা যেতে পারে নাকি সেটা ইনফর্মালি বলা হবে? বাসায় নিজে করলে সেটা পাবলিকলি সার্ফেস না করলে সেটার তো ইমপ্যাক্ট নাই’। ফরহাদ লেখেন, ‘কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান ও অনলাইনে প্রচার; অনলাইনে প্রচার করবে, সবাই আপলোড দিবে; তাইলে সাড়া পড়বে; একটা হ্যাশট্যাগ দিন, যেটা দিয়ে আপলোড দিবে’। মহিউদ্দিন লেখেন, কাল যেহেতু সরকার শোক দিবস ঘোষণা করেছে তাই কাল না করে পরশু সবাই কালো প্রোফাইল পিকচার দিতে পারে লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি। অনলাইন-অফলাইন দুইটাই চলবে। তখন ফরহাদ বলেন, ‘হ্যাশট্যাগ কী দিলে ভাল হয়, যেটা দেখলেই বুঝবে এটা গভর্মেন্টকে খুনি বলা হচ্ছে। অথবা কালকে লাল পতাকা/কাপড় দিতে পারেন’।

পরে লাল কাপড় বেঁধে অবস্থান কর্মসূচি করে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের আহ্বান জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে একটা ড্রাফট প্রেস রিলিজ রেডি করে পাঠান সাদিক কায়েম। এ প্রেস রিলিজের জবাবে ফরহাদ লেখেন, ‘সরকারের অপজিট (কর্মসূচি) হিসেবে কালকে লাল পতাকা/কাপড় দিতে পারেন; রক্তকে লাল দিয়ে বুঝাবে’। তখন মহিউদ্দিন লেখেন, ‘এটাও ভাল আইডিয়া ভাই; সরকারকে রেড সিগন্যাল দিলো’। এসময় ফরহাদ লেখেন, ‘লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার; হ্যাশট্যাগ ফিক্সড করে দেন, @wandererKM’। সাদিক কায়েম লেখেন, ‘চোখে বাঁধার উদ্দেশ্য কী? মুখ বন্ধ করার তো উদ্দেশ্য আছে’। জবাবে ফরহাদ লেখেন, ‘খুন হইলে দেখে না, মেট্রো দেখে, লাল রক্ত চোখে দেখে না’। পরে ফের সংশোধিত প্রেস রিলিজ পাঠান সাদিক। তখন ফরহাদ বলেন, ‘হ্যাশট্যাগ দিবেন’? এসময় মহিউদ্দিন #BlodyBangladesh, #FullOfBlood, #RedToKillers ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ পাঠান। এসময় সাদিক বলেন, ‘এটা স্টেটমেন্টে দেওয়ার দরকার আছে’? জবাবে ফরহাদ বলেন, ‘জ্বি, এটাই তো প্রতিবাদ, বিশ্বব্যাপী এভাবেই হয়’। পরে সাদিক কায়েম জাস্ট ৯টায় চূড়ান্ত প্রেস রিলিজটা পাঠালে ফরহাদ বলেন, ‘দারুণ হইছে’। এরপর ৯টা ৪ মিনিটে মহিউদ্দিন ১০টি হ্যাশট্যাগ (#RedForJustice, #StudentsInRed, #JusticeInRed, #RedForVictims, #JulyMassacre, #StandRedForStudents, #RedAgainstInjustice, #BloodOnTheirHands, #RedAgainstOppression, #StudentsDeserveJustice) পাঠান।

ঢাবি ছাত্রশিবির বলছে, সাদিক কায়েমের তৈরি করা এই প্রেস রিলিজটি এবং মহিউদ্দিনের হ্যাশট্যাগগুলোই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে করা গ্রুপে পাঠানো হয়। পরে তারা ৩০ জুলাইয়ের কর্মসূচি হিসেবে এটির প্রচারণা চালান। যা July Movement (Journalists) নামক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে এক অফিসিয়াল টেলিগ্রামে পাঠানো হয়।
অনুসন্ধান করে ঢাবি শিবিরের এ দাবির সত্যতাও মিলেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টেলিগ্রাম চ্যানেলের ২৯ জুলাইয়ের বার্তাসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদিন রাত ৯টা ৩৭ মিনিটে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণা হিসেবে শিবির সভাপতির তৈরি করা সেই প্রেস রিলিজই প্রদান করা হয়। তবে এর শেষে ৯ দফা দাবিসমূহ এবং বার্তা প্রেরক হিসেবে সমন্বয়ক মাহিন সরকারের নাম যুক্ত করে দেওয়া হয়। এছাড়া, কর্মসূচি সংবলিত প্রেস রিলিজ দেওয়ার পরে রাত ১০টায় টেলিগ্রাম চ্যানেলটিতে ঢাবি শিবিরের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মহিউদ্দিনের দেওয়া ১০টি হ্যাশট্যাগসহ মোট ১১টি হ্যাশট্যাগ দেওয়া হয়।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল কাদের দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ছাত্রদলের নাছির ভাই লাল কাপড় বাধার বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়ার পর আমি সাদিক ভাইকে বিষয়টি জানিয়েছি যে, উনি এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, কী করা যায়? ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি। সাদিক ভাইয়ের সঙ্গে ফরহাদ ভাইয়ের কি কথা হয়েছে না হয়েছে তা আমি জানিনা। ঘটনার প্রেক্ষাপটের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রমান চাইলে তার মোবাইল পরিবর্তন হয়েছে বলে জানান তিনি।
লাল কাপড় বাঁধার প্রস্তাবনা সংবলিত কোনো তথ্য-প্রমাণ আছে কিনা তা জানতে মুঠোফোনে কল দিলে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির ‘নেই’ বলে জানান এবং এ বিষয়ে একটু পরে কথা বলবেন বলে জানান। পরে তার মুখে ২৯ জুলাইয়ের গল্প জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
২৯ জুলাই কর্মসূচির পরিকল্পনা ও ঘোষণার পেছনের গল্প তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি সাদিক কায়েম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, চব্বিশের ১৯ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত যখন প্রথম সারির সমন্বয়করা ছিলেন না তখন প্রতিদিনের কর্মসূচি প্রণয়ন এবং আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের সঙ্গে আমার মাধ্যমে সমন্বয় হতো। তখন সমন্বয়ক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, অ্যাক্টিভিস্ট, ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। ৩০ জুলাই কোন কর্মসূচি ঘোষণা করা যায় সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা অবস্থায়ই হাসিনা ৩০ জুলাইকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির তুষার ভাই আমাকে কল দিয়ে জানান যে, ছাত্রদল রাজপথে মিছিল কর্মসূচি দিতে চায়। তখন আমি তাকে জানাই যে, ভাই আজ আমাদের মাঠের কর্মসূচি ছিল, আজ আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে গেছে। আমরা আগামীকাল সফট কর্মসূচি দিতে চাচ্ছি। সফট এবং হার্ড এই দুইটার সমন্বয়ে ব্যালেন্স করতে হবে। আজকে হার্ড ছিল, আগামীকাল সফট হোক এবং কাল মাঠে নামা আত্মঘাতি হবে। তাকে জানালাম যে, ভাই আমরা এটা নিয়ে আগে আলাপ করি। তারপর জানাই।
তিনি আরও বলেন, এরপর আমি, ফরহাদ এবং মহিউদ্দিন আমাদের ২০২৪ নামের টেলিগ্রাম গ্রুপে আলাপ করলাম। সেই সাথে এ ব্যাপারে সমন্বয়কদের সাথেও কথা বলতে থাকলাম। যেহেতু ২৬ জুলাই আমি বাইরে থাকা সমন্বয়কদের (আব্দুল কাদের, রিফাত রশিদ, মাহিন সরকার, হান্নান মাসুদ ও ছাত্রদলের আব্দুল গাফফার) সেইফ হোম এনশিউর (নিশ্চিত) করেছিলাম। এজন্য তারাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও সমন্বয় হয়। যেহেতু প্রতিদিন আমরাই কর্মসূচির প্রেস রিলিজ তৈরি করে দিতাম সেই ধারাবাহিকতায় আমরা তিনজন (সাদিক, ফরহাদ, মহিউদ্দিন) পরামর্শ করে ৩০ জুলাইয়ের কর্মসূচি হিসেবে চোখে ও মুখে কালো কাপড় বেঁধে সরকারের দেওয়া কর্মসূচি প্রতিহত করার চিন্তা করি। এ প্রেক্ষিতে প্রেস রিলিজ রেডি করতে রায়হান উদ্দিনকে দায়িত্ব দেই। সে একটা ড্রাফট তৈরি করে দেয়। পরে ফরহাদ লাল কাপড় দিয়ে বেঁধে সরকারের ঘোষিত কথিত শোকদিবসকে প্রতিহত করার কর্মসূচি নেওয়ার পরামর্শ দেয়। এরপর মহিউদ্দিন কিছু হ্যাশট্যাগ দেয়। বিষয়টি আমরা ফাইনাল করে সমন্বয়কদেরকে একটি গ্রুপে পাঠাই। তাদের সঙ্গে আমাদের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ ছিল, যা ২৬ জুলাইয়ের পর খোলা হয়। পরে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের পাঠানো প্রেস রিলিজটি মাহিনের নামে যাবে। পরে আমাদের শিবির নেতা রায়হান তা পিডিএফ করে তাদেরকে দেওয়ার পর সাংবাদিক বা সংশ্লিষ্টদেরকে পাঠানো হয়।
লাল কাপড়-প্রোফাইল কর্মসূচি ইস্যুতে সম্প্রতি দেওয়া ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদের সর্বপ্রথম বক্তব্য, যা ঘিরে আলোচনা শুরু হয়
যখন রাষ্ট্র গণহত্যার বদলে নাটকীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় শোক ও কালো পতাকা উত্তোলনের ঘোষণা দেয়, তখন আবু সাদিক কায়েম ভাই আমার কাছে পরামর্শ চায়। ভাই আমাকে বলেন, বল তো কী করা যায়। তখন ভাইকে বলি, আমরা পাল্টা প্রোগ্রাম দেই। তারা যেহেতু কালো দিয়েছে আমরা লাল দেই। আইডিয়া শেয়ার করার পর সাদিক ভাই বললো এটা ভালো হতে পারে। এটাই হোক। তারপর আমরা প্রেস রিলিজ রেডি করে সমন্বয়কদের কাছে পাঠাই। পরে তারা এটি ঘোষণা করে। পরের দিন দেখি রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীর নাগরিক তাদের ফেসবুক প্রোফাইল আপডেট দিচ্ছে। এমনকি ড. ইউনূস, খালেদা জিয়ার ফেসবুক পেজ থেকেও লাল প্রোফাইল শেয়ার করা হয়।
রাষ্ট্র কালো করছে তাই আমরা ভাবলাম আমরা লাল করি, আমরাও পাল্টা কর্মসূচি দেই। লাল তো রক্তের প্রতীক। এর মাধ্যমে আমরা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারি। তারপর মুখে এবং চোখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানানো ও যার যার প্রোফাইলকে লাল করার কর্মসূচি দিলাম।
এমন কর্মসূচি দেওয়ার বড় কারণ হচ্ছে তখন আমরা অনলাইন কর্মসূচি পালন করতাম, সফ্ট কর্মসূচি। হার্ড কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে দেখা গেলো প্রচুর গ্ৰেফতার, মামলা দেওয়া হচ্ছে। পরে আমরা ভাবলাম সফ্ট কর্মসূচি দেই। সফ্ট কর্মসূচি দিয়ে যদি অনেক বেশি সাড়া পাওয়া যায়, তখন আমরা হার্ড কর্মসূচিতে যাবো। যখন এই লাল করার কর্মসূচিটা সাড়া পেল, আমরা মোটিভেশন পেয়ে গেলাম। পরে আমরা মাঠের কর্মসূচিতে গিয়েছি। আমাদের প্রায় এক সপ্তাহের সফ্ট কর্মসূচির লাস্ট স্টেজ ছিল লাল প্রোফাইল দেওয়া।
ফরহাদের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ার পর আব্দুল কাদেরের দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস
জুলাইয়ে আন্দোলনের শেষের দিকের কর্মসূচিগুলা অনেকের সাথে আলাপ আলোচনা কর ঠিক করা হইতো। এক্ষেত্রে শিবিরের সাদেক কায়েম এবং ছাত্রদলের রাকিব-নাসির ভাইয়ের সাথে আলোচনা করতাম। আগের দিন দুপুরের পর থেকে দফায় দফায় আলোচনা করে পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঠিক করা হইতো। তারই ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে পরবর্তী দিন রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন এবং কালো ব্যাজ ধারণের ঘোষণা দেয়। আমাদের কর্মসূচি ঠিক করতে গিয়ে শেষ বিকেলের দিকে নাসির ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়, সরকারের ঘোষিত শোক দিবস এবং কালো ব্যাজ ধারণের বিপরীতে আমাদের লাল ব্যাজ ধারণের প্রস্তাবনা দেন তিনি। রাকিব-নাসির ভাইয়ের সাথে এই বিষয়ে আমাদের একাধিকবার কথা হয়। পরে আমি সাদিক কায়েম ভাইকে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানাই। তিনি বললেন, আলোচনা করে আমাকে জানাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি ফোন দিয়ে সম্মতি দেন। প্রতিদিন কর্মসূচি ফাইনাল করার আগে আমরা চারজন- আমি, মাসউদ, রিফাত, মাহিন আলোচনা করতাম। শিবির এবং ছাত্রদলের সাথে অনেক সময় গ্রুপ কলে মিটিং করে কর্মসূচি ফাইনাল করতাম। তারই ধারাবাহিকতায় ঐদিনও আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম। রিফাত বললো যে, “শোক দিবসের প্রতিবাদে আমরা কালো কাপড় চোখে মুখে বাঁধতে পারি”। আমি রিফাতকে নাসির ভাইয়ের আইডিয়ার কথা বললাম, লীগ যেহেতু কালো কাপড় দিছে, আমরা এইক্ষেত্রে লাল কাপড় বাঁধতে পারি। মাহিনও একই প্রস্তাব দিল।
পরবর্তীতে গতানুগতিক ধারায় বারবার করে সাদিক ভাই এবং নাসির ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে চোখেমুখে লাল কাপড় বাঁধার কর্মসূচি ফাইনাল করা হলো এবং ছবি তুলে প্রোফাইল পিকচার দেওয়ার আহবান জানানো হলো। যাদের কাছে লাল কাপড় নেই, তারা যেনো প্রোফাইল ‘লাল’ করে, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে সেই সময়ে রিফাত রশিদ দেশবাসীর প্রতি এমন আহবান জানিয়েছিলেন। প্রোফাইল পিকচারের সাথে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ জুড়ে দেওয়ার বিষয়ে সাদিক ভাই পরামর্শ দেন, পরামর্শের আলোকে তিনি কিছু হ্যাশট্যাগও দিয়ে দেন।
কাদেরের বক্তব্যের পর এস এম ফরহাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টা কখনোই সফল হবে না, ইনশাআল্লাহ। আমাদের কোনো দাবি বা বর্ণনার বিপরীতে কেউ ভিন্ন কিছু দাবি করলে, প্রয়োজনে সাংবাদিকদের কাছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত ডকুমেন্টস সরবরাহ করা হবে, ইনশাআল্লাহ। ব্যক্তিগত আলাপ, চ্যাট এবং অন্যান্য ডকুমেন্টস সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার পক্ষপাতি নই।
ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে এদিনই (৬ জুলাই) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদের ১ম ফেসবুক স্ট্যাটাস (খণ্ডাংশ)
প্রাথমিকভাবে আমি প্রস্তাব করেছিলাম, হাসিনার লোকজন কালো ব্যাজ ধারনের আহ্বান জানাইছে, আমরা মুখে আর চোখে কালো কাপড় বেধে প্রতিবাদ জানাবো। মুখে কাপড় বাধা মানে বাক স্বাধীনতা হরণ আর চোখে কালো কাপড় বাধা অর্থ এতো এতো গণহত্যাকে চোখ বন্ধ করে মানুষের থেকে আড়াল করার ঘৃণ্য অপচেষ্টার প্রতিবাদ। এইটা প্রাথমিক আইডিয়া হিসেবে নিয়ে আমরা সবগুলো স্টেকহোল্ডারদের সাথে মিটিং করা শুরু করি। মিটিং এর আগেই ছাত্রদলের নাসির ভাই কাদের ভাইকে প্রস্তাব করেছিলো, হাসিনার লোকজন কালো ব্যাজ ধারণ করবে আর আমরা তার বিপরীতে গিয়ে লাল ব্যাজ ধারন করবো। মিটিং এ আবারও যখন উনি সেইম কথা বলেন তখন মাহিন ভাই বলে বসেন যে, তাইলে আমরা এক কাজ করতে পারি। চোখে-মুখে কালো কাপড় না বেধে লাল কাপড় বাধতে পারি। আর জুলাইয়ের রঙ লাল। তখন কাদের আর মাসুদ ভাইও বলেন যে, যদি আমরা কালো কাপড় ইউজ করি তাহলে হাসিনার লোকজন গুজব প্রচার করবে যে আমরা ওদের শোক দিবস পালন করতেসি। কালার আলাদা হইতে হবে। তখন ডিসিশন ফাইনাল হয় যে আমরা চোখেমুখে লাল কাপড় বাধবো।
এই ডিপি আপলোড করার সময় কিছু হ্যাশট্যাগ ইউজের প্রস্তাব করে শিবিরের সাইমুম ছদ্মনামের একজন। তখন আমরা বলি সম্ভাব্য কি কি হ্যাশট্যাগ দেয়া যায় সেইটার একটা তালিকা প্রস্তাব করতে বলি। তারা সেটা পাঠায়ও। এরপরেই চোখেমুখে লাল কাপড় বাধার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এবার আসি ডিপি লাল করার ব্যপারটায়। এইটা হইসে একটা অর্গানিক জিনিস। এই ডিপি লাল প্রথম করে আমাদের ২১-২২ এর ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়া ছাত্রশক্তির ছোটভাই নুরুল ইসলাম নাহিদ। ও এই আইডিয়াটা মূলত পাইছিলো পরিষদে থাকাকালে আমরা হাসিনার কোনো ব্যপারকে প্রত্যাখ্যান করতে লালকার্ড প্রদর্শনী প্রোগ্রাম করতাম প্রায়শই সেখান থেকে। লাল কাপড় চোখেমুখে বাধা কঠিন হওয়ায় ঠিক ১২ টায় 'শোক দিবসকে লালকার্ড দেখিয়ে দিলাম' টাইপের একটা ক্যাপশন দিয়ে আপলোড করে দেয়। ওইটা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কপি করা শুরু করে, আমরাও এপ্রিশিয়েট করেছিলাম কারণ কাপড় চোখেমুখে বাধা সবার জন্য কঠিন হইলেও ডিপি লাল করাটা ইজিয়ার। রাত একটা বাজতে বাজতে চোখেমুখে লাল কাপড় বাধার ব্যপারটার চেয়েও ডিপি লাল করাটা ট্রেন্ডে চলে আসে আর আমরাও সেলিব্রেট করি।
সোমবার (৭ জুলাই) দুপুরে দেওয়া রিফাতের ২য় ফেসবুক স্ট্যাটাস (খণ্ডাংশ)
গতকাল (রবিবার) কাদের ভাই আর আমি পোস্ট দিলাম নাসির ভাই লাল ব্যাজ ধারনের পরামর্শ দিয়েছেন। ছাত্রদল চেয়েছিলো লাল ব্যাজ ধারণ করে মিছিল করার। কিন্তু আমি চাইছিলাম সামথিং এনগেজিং, এমন কিছু যেটা যারা মাঠে যেতে পারছে না তারাও কানেক্ট করবে, এমন কিছু যেইটা ফ্যাসিস্ট আর আমাদের আলাদা করবে পাবলিক স্ফেয়ারে। আমি তাই ইনিশিয়াল আইডিয়া দেই হাসিনার শোক দিবস প্রত্যাখ্যানের। চোখেমুখে কালো কাপড় বাধা দিয়ে গণহত্যাকে আড়াল আর বাকস্বাধীনতা হরণের মতো দুইটা মেজর ফ্যাসিবাদী কাজকামকে সিম্বলাইজ করি। মিটিং এ ছাত্রদলের মিছিলের প্রস্তাবের চেয়ে ডিপি চেঞ্জ করার প্রস্তাব গ্র্যান্ট হয় সবার মতামতেই।
তারপর আসলো কাপড়ের কালার কি হবে সেইটা নিয়ে। এক্ষেত্রে নাসির ভাইয়ের প্রস্তাব করা লাল ব্যাজের আইডিয়া থেকে মাহিন ভাই চোখেমুখে লাল কাপড় বাধার প্রস্তাব করে। কাদের ভাই আর মাসুদ ভাইও সেখানে সায় দেয় কারণ হাসিনার গুজব বাহিনী কালো কাপড়ের ক্ষেত্রে আমরা হাসিনার শোকদিবস পালন করছি এমন ন্যারেটিভ বাজারে দেবে। তাই লাল কাপড় চোখেমুখে বাধার ডিসিশন নেয়। শিবির এক্ষেত্রে বেশ ভালো ভালো কিছু হ্যাশট্যাগ জেনারেট করে দেয়।
আর ডিপি লাল করার ব্যপারটা অর্গানিক, ইন্সট্যান্ট সলিউশন হিসেবে ম্যানেজমেন্টের ছোটভাই ছাত্রশক্তির নুরুল ইসলাম নাহিদের করা একটা এক্টিভিটি যেইটাকে পরে আমরা এপ্রিশিয়েট করি এবং ম্যাসিভ স্কেলে ছড়াইয়া দেই।
নাসির ভাই ডিপি লাল করার মাস্টারমাইন্ড এই আলাপটাও ভিত্তিহীনই। আমি নিশ্চিত নাসির ভাই নিজেও এই দাবী করবেন না। একটা ইনিশিয়াল আইডিয়া অনেকের মতামতের ভিত্তিতে পূর্ণতা পাইছে। কিন্তু একদল গ্রুপ নাসির ভাইয়ের নামটা আলাপে আসায় ডিপি লালের ক্রেডিট পর্যন্ত নাসির ভাইকে তুলে দিচ্ছে, এই ন্যারেটিভ দিয়ে বাজার সয়লাব করে দিছে। অথচ নাসির ভাই ফেসবুক ডিপি রিলেটেড আলাপই দেয় নাই। তিনি মাঠে মিছিলের পক্ষে প্রস্তাব দিসিলেন।
৬ জুলাই রাতে রিফাত রশিদের ১ম স্ট্যাটাসটি শেয়ার করে ফেসবুকে দেওয়া মাহিন সরকারের স্ট্যাটাস
জনৈক তারেক আহমেদ বললেন ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো শিবির নেতা ফরহাদ। এই তারেক কি পলিসির জায়গায় ছিলো? সাইমুম ছিলো পলিসিতে, সালমান ছিলো - এরা ছিলো শিবিরের। প্রোফাইল লাল করার আইডিয়া আমাদের কারোরই ছিলো না, পরিকল্পনা ছিলো চোখেমুখে লাল কাপড় বাঁধার। জুনিয়র নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম প্রোফাইল লাল করে। ছাত্রশিবির যেই ঘৃণ্য অপরাধ করলো ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করে সেটা তাদের গাদ্দারিরই ধারাবাহিকতা মাত্র। বিভাজনের প্রথম সূচনা এদের হাত ধরেই হয়েছে।
২৯ জুলাই তৎকালীন ঢাবি শিবির সভাপতি সাদিক কায়েমের তৈরিকৃত প্রেস রিলিজের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক প্রেস রিলিজের মিল
সাদিক কায়েমের তৈরিকৃত প্রেস রিলিজটিতে আগে ঘোষিত নয় দফা দাবি ও বার্তা প্রেরক হিসেবে মাহিন সরকারের নাম যুক্ত করে সাংবাদিকদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক প্রেস রিলিজ হিসেবে প্রদান করা হয়। বাকী মূল তথ্যগুলো অমিল রাখা হয়।

২৯ জুলাই তৎকালীন ঢাবি শিবির সাংগঠনিক সম্পাদক মহিউদ্দিন খানের দেওয়া হ্যাশট্যাগ
#RedForJustice, #StudentsInRed, #JusticeInRed, #RedForVictims, #JulyMassacre, #StandRedForStudents, #RedAgainstInjustice, #BloodOnTheirHands, #RedAgainstOppression, #StudentsDeserveJustice ইত্যাদি।

অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টেলিগ্রাম চ্যানেলে দেওয়া হ্যাশট্যাগ
#RedForJustice, #StudentsInRed, #JusticelnRed, #RedForVictims, #JulyMassacre, #StandRedForStudents, #RedAgainstInjustice, #BloodOn Their Hands, #RedAgainstOppression, #Students Deserve Justice, #StudentsAgainstOppression, #JulyMassacre ইত্যাদি।