
বিকেলের মৃদু রোদে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বৈগুনি গ্রামে নিজের অসমাপ্ত পাকা ঘরের সামনে বসে পেটের ডান পাশের ব্যথা আর পোড়া পোড়া অনুভূতি নীরবে সহ্য করছিলেন ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন । ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে তিনি ভারতের এক হাসপাতালে নিজের কিডনি বিক্রি করেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় । স্বপ্ন ছিল , দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবেন , তিন সন্তানের জন্য ভালো একটি ঘর তৈরি করবেন । কিন্তু সেই টাকা বহু আগেই শেষ । ঘর এখনো অসমাপ্ত । শরীরের ব্যথা প্রতিদিন তাঁকে মনে করিয়ে দেয় , তিনি কী ভয়ংকর মূল্য দিচ্ছেন । সফিরুদ্দিন এখন কাজ করেন স্থানীয় একটি কোল্ডস্টোরেজে । শরীরের অবস্থা ভালো নয় । সারাক্ষণ ব্যথা আর ক্লান্তিতে ভোগেন ।
তিনি বলেন , ‘ আমার পরিবার যাতে ভালো থাকতে পারে , সে জন্যই কিডনি দিয়েছিলাম । স্ত্রী আর সন্তানদের জন্যই সব করেছি । ' তিনি বলেন , যখন তিনি কিডনি বিক্রি করেন , তখন বিষয়টি তেমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত মনে হয়নি । তাঁর কাছে আসা দালালেরা সবকিছু সহজ আর ঝুঁকিমুক্ত বলেই বুঝিয়েছে । তারা বলেছে , এটা একটা সুযোগ , বিপদের কিছু নয় । শুরুতে সন্দেহ হলেও দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁকে হার মানতে হয়েছে । কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সফিরুদ্দিনের এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা । শুধু তিনিই নন , জয়পুরহাটের কালাইয়ের বৈগুনি গ্রামে তাঁর মতো অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেছেন । গ্রামটির নামই হয়ে গেছে এখন ‘ এক কিডনির গ্রাম ' । আর কিডনি বিক্রির হটস্পট হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে কালাই উপজেলা ।
২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয় , ওই অঞ্চলের প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন । আল জাজিরার তথ্যমতে , প্রতিটি কিডনির দাম ২২ থেকে ২৬ হাজার ডলার ( বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৭ লাখ থেকে ৩২ লাখ টাকা ) । কিন্তু বিক্রেতারা পায় সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা । বাকি টাকা দালাল , ভুয়া কাগজ প্রস্তুতকারী , চিকিৎসক ও অন্যান্য খাতে যায় । আরও ভয়াবহ বিষয় হলো , অনেকে চাকরির লোভে ভারতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন । কাজের নাম করে নিয়ে গিয়ে জোর করে কিডনি নেওয়া হয় । ২০২৩ সালে এভাবে দিল্লিতে ১০ জন বাংলাদেশিকে কিডনি বিক্রির ফাঁদে ফেলা হয় । পরে ঢাকায় তিন পাচারকারী ধরা পড়ে ।
বাংলাদেশিদের কিডনি পাচার শেষ পৃষ্ঠার পর সফিরুদ্দিন জানান , দালালেরা তাঁকে মেডিকেল ভিসা দিয়ে ভারতে নিয়ে যায় । ফ্লাইট , কাগজপত্র , হাসপাতালের নানা আনুষ্ঠানিকতা — সবকিছু তারাই ঠিকঠাক করে দেয় । ভারতে পৌঁছানোর পর কিডনি গ্রহীতার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রমাণ করার জন্য তাঁর জাল পরিচয়পত্র তৈরি করা হয় । এমনকি তাঁর পরিচয়ও বদলে ফেলা হয় । সফিরুদ্দিন বলেন , পাচারকারীরা নকল কাগজ , ভুয়া পরিচয়পত্র , এমনকি ভুয়া ডিএনএ রিপোর্ট পর্যন্ত তৈরি করে আইনকে ফাঁকি দেয় । কালাই উপজেলা বাংলাদেশের অন্যতম দরিদ্র এলাকা । অধিকাংশ কিডনি বিক্রেতা ৩০ - এর কোটায় থাকা পুরুষ । ৮৩ শতাংশ লোকই বলেছেন , দারিদ্র্য তাঁদের কিডনি বিক্রিতে বাধ্য করেছে । কেউ কেউ ঋণ পরিশোধ , মাদকাসক্তি কিংবা জুয়া আসক্তির কারণেও এই পথে গেছেন । ভারতে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ মানুষ চূড়ান্ত পর্যায়ের কিডনি রোগে আক্রান্ত হয় , অথচ ২০২৩ সালে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০ টি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে ।
সফিরুদ্দিন বলেন , দালালেরা তাঁর পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে । এমনকি অস্ত্রোপচারের পর যে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল , সেটাও পাননি তিনি । কালাইয়ের বিনাই গ্রামের ৪৫ বছরের জোসনা বেগমও একই পথে গেছেন । ২০১২ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই মেয়েকে ( ১৮ ও ২০ বছর বয়সী ) নিয়ে জীবনসংগ্রামে নেমেছিলেন । ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় বেলালের সঙ্গে , পরে তাঁরা বিয়ে করেন । বিয়ের কিছুদিন পর ২০১৯ সালে এক দালালের প্রলোভনে পড়ে ভারতে গিয়ে দুজনেই কিডনি বিক্রি করেন । অনেকে আবার কিডনি বিক্রির পর নিজেরাই দালাল হয়ে যান ।
ঢাকার মোহাম্মদ সজল ( ছদ্মনাম ) ইভ্যালির মাধ্যমে গৃহস্থালির জিনিসপত্র বিক্রি করতেন । ২০২১ সালে ইভ্যালি প্রতারণার পর তিনি সর্বস্বান্ত হন । ধার- দেনার চাপে পড়ে ২০২২ সালে তিনি নিজের কিডনি বিক্রি করেন ভারতের দিল্লির ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতালে । কিন্তু ১০ লাখ টাকার কথা থাকলেও তিনি পান মাত্র ৩ লাখ ৫০ হাজার । পরে তিনিও দালালের সঙ্গে যুক্ত হন , আরও অনেক বাংলাদেশিকে ভারতের হাসপাতালে নিয়ে কিডনি বিক্রির ব্যবস্থা করেন । পরে টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দালালদের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে ভয় পেয়ে কাজ ছেড়ে দেন তিনি । তাঁর ভাষায় , দুই দেশের হাসপাতাল থেকে শুরু করে চিকিৎসক , দালাল— সবাই মিলে পুরো চক্রটি চালায় ।
বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক ( এআইজি ) ইনামুল হক সাগর বলেন , এরই মধ্যে অনেক দালাল গ্রেপ্তার হয়েছে বলেও জানান তিনি । ভারতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দিল্লি পুলিশ কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন বিজয়া রাজাকুমারিকে গ্রেপ্তার করে । তদন্তে জানা যায় , ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি দিল্লির এক বেসরকারি হাসপাতালে অন্তত ১৫ জন বাংলাদেশি রোগীর ট্রান্সপ্লান্ট করেছেন । ভারতের দিল্লি পুলিশের উপকমিশনার অমিত গোয়েল বলেন , অনেক সময় হাসপাতালের অনুমোদন বোর্ড ভুয়া কাগজ শনাক্ত করতে পারে না । ফলে অনুমতি দিয়ে দেয় ।