
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে একুশে পদকপ্রাপ্ত আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘র্যাব থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করুন। র্যাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ঢোকানো রং কনসেপ্ট ছিলো। তাই সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ; উভয়ের স্বার্থে র্যাব থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করা দরকার। এই সরকার পুলিশ রিফর্মের (সংস্কার) অংশ হিসেবে এটা করতে পারে বলে প্রস্তাব দেন তিনি।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার: প্রেক্ষিত নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে আমার দেশ সম্পাদক এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক ডিআইজি ড. মতিয়ার রহমান। সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সভাপতি ড. এম আকবর আলী।
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে অংশ নেন—বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর, বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. কামরুল আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. বোরহান উদ্দিন খান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, এনসিপির জারিফ রহমান, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ফরিদ আহম্মেদ, ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক প্রফেসর শরিফুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, সাবেক সচিব এস এম জহুরুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা প্রমুখ।
সভাটি সঞ্চালনা করেন অনুষ্ঠানের সংগঠনের সহসভাপতি আব্দুর রহমান খান।
র্যাব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এক আলোচকের বক্তব্যের সূত্র ধরে একুশে পদকপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন—র্যাব অনেক ভালো কাজ করেছে। কিন্তু র্যাবে সামরিক কর্মকর্তাদের ঢোকানো ছিলো একটা ভুল। আমি আগেও বলেছি—এখনো বলছি, ভবিষ্যতেও বলে যাবো। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের র্যাবে ঢোকানোর পরে দুটো বাহিনীর সর্বনাশ করেছেন। পুলিশেরও সর্বনাশ করেছেন, সামরিক বাহিনীরও সর্বনাশ করেছেন। সামরিক বাহিনী র্যাবে ঢুকে করাপ্ট (দুর্নীতিপরায়ণ) হয়েছে, ক্রিমিনাল হয়েছে। ক্রিমিনাল হওয়ার কারণে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন হয়েছে। আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। লে. কর্নেল তারেক সাইদ এর চরিত্র নষ্ট হয়েছে র্যাবে আসার কারণে। এ কারণে সামরিক বাহিনীও বিতর্কিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীও রাজনীতিকরণ হয়েছে। এটা ছিলো রং কনসেপ্ট। এটা ছিলো যে-ই করে থাকুক না কেন। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সামরিক বাহিনীকে ঢুকানো।
তিনি বলেন—অন্তত একটা কাজ করে যান পুলিশের রিফর্ম (সংস্কার) হিসেবে— র্যাব থেকে সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার করুন। এই রিফর্মটুকু যদি করে যেতে পারেন, আপনাদেরকে দেশবাসী মনে রাখবে। এটা করতে সাত দিনের দরকার। পুলিশে এলিট ফোর্স লাগবে কিন্তু এলিট ফোর্স অবশ্যই পুলিশ বাহিনী থেকে নিয়ে গঠন করতে হবে। আমার প্রস্তাব হলো—এই এলিট ফোর্স ট্রেনিংয়ের জন্যে সেনাবাহিনীতে পাঠান। ট্রেনিং নিয়ে আসুক। কিন্তু সামরিক বাহিনীর লোকদের ঢুকিয়ে দুটো প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ করবেন না। এই সরকারের জন্যে এটা ট্রিমেন্ডাস অপরচুনিটি (অসাধারণ সুযোগ)।
চট্টগ্রামের পটিয়া এবং লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানায় আক্রমণের ঘটনা উল্লেখ করে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, ‘এ রকম যদি ঘটতে থাকে, তাহলে কিভাবে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন করতে পারবো। এই সরকারের জন্যে এটা বিগেস্ট (সবচেয়ে বড়) চ্যালেঞ্জ। পুলিশের হারিয়ে যাওয়া মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। এই সরকারের কাছে আর কোনো সংস্কার আশা করে লাভ নেই।’
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানায় আক্রমণ করে বিএনপি নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘এটা এক ধরনের প্রতিশোধ। ম্যাজিস্ট্রেট সাজা দিয়েছে, এরকম সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আপনি থানায় গিয়ে লোকজন নিয়ে পুলিশকে পিটিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন, তাহলে স্টেট কোথায়? পুলিশ এবং সরকার কী করলো? সরকার কেন পারলো না, পুলিশ কেন পারলো না? থানায় আক্রমণ হলো কেন? হয়তো তাদের (পুলিশের) জনবলের অভাব ছিলো, আমি জানি না। কিন্তু তারা (পুলিশ) ব্যর্থ হয়েছে। থানা আক্রমণ করে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার চেয়ে বড় অপরাধতো আর কিছু হতে পারে না। এরকম একটা পুলিশ দিয়ে আসলে কি আমরা একটা ফ্রি, ফেয়ার ইলেকশন করতে পারবো। এটা বড় প্রশ্ন’।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অন্তত একটা নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেন। সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে হলে পুলিশের মনোবল অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য যা যা করা দরকার করতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারের উচিৎ এই ওয়ান পয়েন্ট এজেন্ডাতে (শান্তিপূর্ণভাবে ফ্রি, ফেয়ার ইলেকশন করা) মনোনিবেশ করা। বড় বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি এবং অন্যান্য যারা আছেন সবাই মিলে একটা নির্বাচন করতে। এই নির্বাচনে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা হবে না, এই গ্যারান্টি আপনাদের দিতে হবে। নির্বাচন নিয়ে আমার মনে হয়, এখনই আলোচনা শুরু করে দেয়া উচিৎ। ঐক্যমত কমিশন চলুক ঐক্যমতের মতো। নির্বাচন নিয়েও এখন আলোচনা শুরু করা উচিৎ। কারণ এই দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি বিশৃঙ্খলা করে, তাহলে কিন্তু গণতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব হবে না। গণতন্ত্রে যদি শান্তিপূর্ণভাবে উত্তরণ না হয়, তাহলে বাংলাদেশের পরিণতি কী হবে; আমি আশংকাবোধ করি। সুতরাং আমরা চাই ফ্রি, ফেয়ার ইলেকশন হয়ে যাক। পতিত ফ্যাসিবাদ ছাড়া সবাই আশা করে বাংলাদেশ ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন করে গণতান্ত্রিক সিস্টেমেটিক রাষ্ট্রে চলে যাই।’
কুষ্টিয়ায় আদালত চত্বরে আক্রমণের ঘটনা তুলে ধরে মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘ওই আক্রমণের মাস্টারমাইন্ড ছিলো শেখ হাসিনা। সে নির্দেশ দিয়েছিলো এসপিকে। বাস্তবায়ন করেছিলো তৎকালীন এসপি মেহেদী হাসান। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই পুলিশের এতোটা অধ:পতন হয়, যার প্রমাণ আমরা দেখেছি।’
রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় নির্যাতন করার কথা উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘থানায় বাতি নিভিয়ে সেলের মধ্যে ঢুকে আমাকে নির্যাতন করেছে। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মতো একজন সিনিয়র সিটিজেনকে থানায় ঢুকে বাতি নিভিয়ে যদি এভাবে নির্যাতন করা হয়, তাহলে জনসাধারণের কী অবস্থা? এভাবে নির্যাতন করার ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে কিনা জানা নেই। রাতের বেলায় গারদে ঢোকারতো নিয়মই নেই, তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া। কীভাবে সম্ভব, এটাতো ভাবাই যায় না। এটা বাংলাদেশে ঘটেছে’।
পুলিশের নিচের পর্যায়ের কর্মরতদের জন্য কষ্ট লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার খুব কষ্ট লাগে। রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে ধুলাবালির মধ্যে। তাদের প্রাকৃতিক কাজ করার জায়গা নেই। রোদের মধ্যে পলেস্টারের শার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকে। অবিশ্বাস্য! এই পুলিশের প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে। বললে হবে না, পুলিশ ট্রাক ওয়ালার কাছ থেকে ১০০ টাকা নেয়। সে যে মানবেতর জীবন যাপন করছে, সেটা তো ভাবতে হবে। কর্মঘণ্টা ১২ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি। দাঁড়িয়ে থেকে কীভাবে এত কষ্ট করছে’।