Image description
অবসর সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ » আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধন করা হচ্ছে অধ্যাদেশ , খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন । » কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালে দেওয়া হবে পেনশনসহ সব আর্থিক সুবিধা । >> অনানুগত্য ও অনুপস্থিতির ধারা বাদ যাচ্ছে , অভিযোগ যাচাই ৩ সদস্যের কমিটিতে ।

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধন করে অসদাচরণের জন্য সরকারি কর্মচারীদের চাকরি থেকে অপসারণ ও বরখাস্তের বিধান বাদ দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার । এর পরিবর্তে পেনশনসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে যে কাউকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিধান করা হচ্ছে । জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে । সূত্র বলেছে , সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই সংশোধন করা হচ্ছে ।

লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে এ - সংক্রান্ত সরকারি চাকরি ( দ্বিতীয় সংশোধন ) অধ্যাদেশ , ২০২৫ - এর খসড়া গতকাল বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ । প্রধান উপদেষ্টা ড . মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয় । অধ্যাদেশ সংশোধন করে বরখাস্তের দণ্ডের বদলে কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে , সে বিষয়ে কিছু জানায়নি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ।

সরকারি কর্মচারী ( শৃঙ্খলা ও আপিল ) বিধিমালা , ২০১৮ অনুযায়ী , সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দিয়ে তাঁদের চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যায় । তবে বিভাগীয় মামলা দিয়ে এভাবে দণ্ড দিতে দীর্ঘ সময় লাগে । জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায় , সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধন করে অল্প সময়ের মধ্যে যে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পথ তৈরি করা হচ্ছে । জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন , উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা- নিরীক্ষা করবে । এরপর তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে । রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর অধ্যাদেশ সংশোধন করা হবে ।

সূত্র জানায় , অধ্যাদেশটি সংশোধন করে অনানুগত্য এবং কোনো কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে বা কাজ না করার জন্য উসকানি ও প্ররোচিত করার ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে । বর্তমান অধ্যাদেশ অনুযায়ী , ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নোটিশ দিয়েই অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারবেন । সূত্র বলেছে , অধ্যাদেশের সংশোধনীতে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে । এই কমিটিতে আবশ্যিকভাবে একজন নারী রাখা হবে । তদন্তের আদেশ পাওয়ার পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে আবশ্যিকভাবে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে হবে । নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন না দিলে তদন্ত কমিটির সদস্যদের অদক্ষতা হিসেবে গণ্য করে তাঁদের এসিআরে তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে । প্রয়োজনে তদন্ত কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে ।

জানা গেছে , সংশোধনীতে এই অধ্যাদেশের আলোকে কাউকে দণ্ড দেওয়া হলে দণ্ড আরোপের আদেশ পাওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করার সুযোগ রাখা হচ্ছে । বর্তমান অধ্যাদেশে আপিল - সংক্রান্ত বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে । জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন , খসড়ায় অপসারণ ও বরখাস্তের দণ্ড বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে । এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে যেকোনো সময় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যাবে । তাঁকে পেনশনসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে ।

সরকারি কর্মচারী ( শৃঙ্খলা ও আপিল ) বিধিমালা , ২০১৮ অনুযায়ী , বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ব্যক্তি পেনশন সুবিধা পেলেও এক বছরের অবসরোত্তর ছুটি ( পিআরএল ) এবং ১৮ মাসের ছুটি নগদায়নের সুবিধা পান না । এ ছাড়া সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরিতে নিয়োগের অযোগ্য হন তিনি । তবে সংশোধিত চাকরি অধ্যাদেশের খসড়ায় কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালে পিআরএল এবং ছুটি নগদায়নের সুবিধা দেওয়া হবে কি না , উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশনার আলোকে সেই সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি জানান । সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী কারও চাকরির বয়স ২৫ বছর হলে কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে সরকার জনস্বার্থে তাঁকে অবসরে পাঠাতে পারে । এ ক্ষেত্রে তিনি পেনশন , পিআরএল এবং ছুটি নগদায়নের সুবিধাসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা পান । চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করার বিধান রেখে গত ২৫ মে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি করে সরকার । এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন কর্মচারীরা । তাঁদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাদেশটি পর্যালোচনার জন্য আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে ৪ জুন একটি কমিটি করে সরকার । কমিটির সদস্যরা আন্দোলনরত কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে দুই দিন বৈঠক করেছেন । এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অধ্যাদেশ সংশোধন করা হচ্ছে । বর্তমান অধ্যাদেশে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে ।

সূত্র জানায় , সংশোধনীতে এ বিষয়ে নতুন একটি ব্যাখ্যা যোগ করা হচ্ছে । ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে , কেউ যদি দাপ্তরিক কাজের বাইরে ব্যক্তিগত জরুরি কাজের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে না বলে কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকেন , সে জন্য চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না । সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করা সচিবালয় কর্মকর্তা - কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো- চেয়ারম্যান বাদিউল কবীর গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ অনানুগত্যের ধারাটি বাদ দেওয়া হচ্ছে । এটি বাদ দিলে অধ্যাদেশটি এমনিতেই বাতিল হয়ে যায় । উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকেও আমাদের বিষয়টি জানানো হয়েছিল । বাকি যেগুলো আছে চাকরি আইন , ২০১৮ এবং সরকারি কর্মচারী ( শৃঙ্খলা ও আপিল ) বিধিমালা , ২০১৮- এর সঙ্গে মিল রয়েছে । ' তিনি বলেন , ‘ কারণ দর্শানোর সুযোগ রাখা , তদন্ত কমিটি গঠন এবং নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য কমিটিতে একজন নারী রাখার বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব সরকার মেনে নিয়েছে । ফলে আমাদের শঙ্কার জায়গাগুলো নিরসন হচ্ছে । ' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন , সরকারের নির্দেশনার আলোকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের খসড়া করে । কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে এখন সরকার অধ্যাদেশে যেসব সংশোধন করতে চায় , সে বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে লিখিত নির্দেশনা দিয়েছে । ওই নির্দেশনার আলোকে সংশোধিত খসড়া করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন , সরকারি কর্মচারী ( শৃঙ্খলা ও আপিল ) বিধিমালার মতো করে বিষয়টি সংশোধন করা হচ্ছে । এ ক্ষেত্ৰে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হবে সংক্ষিপ্ত সময়ে । বর্তমান অধ্যাদেশে আপিল রিভিউয়ে অসংগতি রয়েছে , সেটি সংশোধন করছে কি না , তা দেখতে হবে । তিনি বলেন , “ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মতো বিধিবদ্ধ সংস্থায় যাঁরা চাকরি করেন , তাঁদের জন্য এই অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে না । তাহলে তো আইন দুই রকম হয়ে গেল । চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল করে সব সরকারি কর্মচারীর বেআইনি আন্দোলন দমনের জন্য আলাদা একটি কঠোর আইন করা দরকার ছিল । '