Image description

ডেঙ্গুর ভয়াবহ থাবা সর্বত্রই। গত বছরের চেয়ে এ বছর দেশ জুড়ে ডেঙ্গুর তাণ্ডব অনেকটাই বেশি। স্থানীয় সরকার কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে মশাবাহিত রোগটি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। স্থানীয় সরকারের মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম গতিহীন থাকায় মানুষ প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন এডিস মশায়। এরপর হাসপাতালে ভিড় করছেন। হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এবার রাজধানী ঢাকার পর বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। উপকূলীয় এই জেলাটি এখন ডেঙ্গুর হটস্পট। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। 

আইডিসিআর সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ডেঙ্গু রোগী বেশি শনাক্ত হচ্ছে। জেলাটিতে সুপেয় পানির অভাব। বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন বাসিন্দারা। তাতে পুরনো পানি থেকেই যায়। এতেই মূলত মশা ডিম পাড়ে। প্রজনন বাড়ে। আইইডিসিআর’র প্রিন্সিপাল বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রত্না দাস স্থানীয় সরকারের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। স্থানীয় সরকারের জনবলের অভাবে কাজে গতিহীন রয়েছে। 

চলতি বছরের ৩রা জুলাই পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত রোগটিতে ৪৫ জনের মৃত্যু হলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০ জন মারা গেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪৫৬ জনে। এবার সবচেয়ে বেশি ৫ হাজার ৭০ জন আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন বরিশাল বিভাগে, যা মোট রোগীর ৪৪ শতাংশ। এরমধ্যে বরগুনা জেলায় রয়েছেন ৩ হাজার ১৯ জন।

কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার চলতি বছরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা  করেছেন। এই বিষয়ে তিনি মানবজমিনকে বলেন, এবার স্থানীয় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে এডিস মশার বিস্তারে কিছু বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে মশার কামড়ে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন। তিনি আরও বলেন, গত ২৬ বছরে ঢাকা শহরের মানুষ ডেঙ্গুর বিভিন্ন ধরনে আক্রান্ত হওয়ায় ৫০ শতাংশ সংক্রমণের চ্যান্স কমে গেছে। ফলে গ্রামে নতুন করে সংক্রমণের সুযোগ বেড়ে গেছে। মশাবাহিত এই রোগটি ঢেউয়ের মতো। আস্তে আস্তে ছড়ায়। তিনি বলেন, এখনই যদি মোকাবিলা করা না যায় তাহলে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের অনেক জেলায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আমাদের গবেষণা ফোরকাস্টিং মডেলের ভিত্তিতে বলা যায়, আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুর জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক রূপ নিতে পারে। মে মাসের তুলনায় জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্রবণতার ভয়াবহতা নির্দেশ করে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গু প্রবৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে বাড়বে, যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে লার্ভা ধ্বংস সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলেও দেশে অনেক এলাকায় নিয়মিত মনিটরিং বা লার্ভা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। জনবল সংকট, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলো এ কাজে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। এর ফলে অনেক এলাকায় নিভৃতে লার্ভা বেড়ে উঠছে এবং তা ডেঙ্গুর বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবও ডেঙ্গু মোকাবিলায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই জানে না কোথায় মশা ডিম পাড়ে, কীভাবে লার্ভা ধ্বংস করতে হয় কিংবা এডিস মশা কখন কামড়ায়। কেউ কেউ জানলেও দায়িত্ববান আচরণ করে না, বাড়ির ছাদ, বারান্দা বা আঙিনায় জমে থাকা পানির প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করে না। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তন এখন এডিস মশার বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করছে। ডেঙ্গুর বর্তমান এই পরিস্থিতি শুধু একটি রোগ নয়, বরং এটি জলবায়ু, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সম্মিলিত সংকট, যার সমাধান জরুরি। এই সংকট মোকাবিলায় ব্যাপক ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়।

ড. কবিরুল বাশার মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি বলে উল্লেখ করে বলেন, সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মৌসুমের শুরুতেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেটি বাস্তবায়নে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন। যেসব সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মশা নিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রশিক্ষিত জনবল নেই, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কীটনাশক বাছাই করে তা সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ। কোন কীটনাশক কোন ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে হবে, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া দরকার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনসাধারণকেও সতর্ক অবস্থায় থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।