
বুকফাটা কান্না চেপে ধরে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন খাদিজা খাতুন, শহীদ নুর আলমের বিধবা স্ত্রী। চোখ ভেজা, কণ্ঠ ভারি—‘আমার স্বামী আমাকে তার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসতো। যখন আমার বাচ্চা আব্বু আব্বু করে ডাকে, আমার কলিজা ফেটে যায়। আমি কিছুই বলতে পারি না। বাচ্চার মুখের দিকে তাকালে, আমার একটা করে দিন এক বছরের সমান হয়ে যায়। স্বৈরাচার হাসিনা আমার সুখের সংসারটা তচনচ করে দিছে।’
২০২৩ সালের ২০ জুলাই ছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা খাদিজা খাতুন তখন ঢাকার গাজীপুর চৌরাস্তার তেলিপাড়ার এক ভাড়া বাসায় ছিলেন। তার স্বামী, নুর আলম—পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। সেদিনের মতো কাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় বাড়ি আর ফেরা হয়নি তার।
সেদিন বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের তুমুল উত্তেজনার মধ্যে গাজীপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নুর আলম। একটি গুলি এসে সরাসরি তার চোখে লাগে। তৎক্ষণাৎ ঢলে পড়েন মাটিতে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান এই সংগ্রামী মানুষটি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শুধু একটি ভাড়া বাসায় জীবন পরিচালনা করতেন নুর আলম।
স্ত্রী খাদিজা বলেন, ‘যখন শুনেছি আমার স্বামী মারা গেছে, তখনি মনে হয়েছে আকাশটা আমার মাথার ওপরেই ভেঙে পড়েছে। স্বৈরাচার হাসিনা আমার স্বামীটাকে মেরে ফেললো। আমার সন্তানকে এতিম করলো। আমার স্বামী সুখের সংসার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল, হাসিনা সে স্বপ্নও কেড়ে নিল। আমি ওর ফাঁসি চাই। আমি বিচার চাই, যারা গুলি করেছে তাদেরও ফাঁসি চাই।’
নুর আলমের মৃত্যু শুধু খাদিজা খাতুনকে বিধ্বস্ত করেনি, ভেঙে দিয়েছে একটি অচলা সংসারের ভিত্তি। শহীদ হবার ৪৪ দিন পর শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেন, ‘যত প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা আসছে সব আমার শ্বশুর নিয়েছে। আমাকে কিছুই দেয়নি। আমি নিরুপায় হয়ে বাবার বাড়ি চলে আসি। বাচ্চার জন্মও হয় সেখানে।’
২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, বাবার বাড়ি কুড়িগ্রামের মুন্সিপাড়া কাচিচর গ্রামে জন্ম নেয় শহীদ নুর আলমের সন্তান। কিন্তু জন্মের পরই জানা যায় শিশুটির হার্টে সমস্যা রয়েছে। আজও সরকারি সাহায্য কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের কেউ তার খোঁজ নেয়নি।
নুর আলমের শ্বশুর নন্দু মিয়া বলেন, ‘আমার মেয়ের সংসার তছনছ হয়ে গেছে। আমার জামাইয়ের হত্যার বিচার চাই। আমার নাতি এখন এতিম। সরকারের উচিত এর দায়িত্ব নেওয়া।’
শহীদ নুর আলমের বাবা আমীর হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলেকে হারিয়ে আমি অসহায়। আমি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছি। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে যত সহায়তা আসছে, তা ছেলের বউয়ের কাছে গেছে, আমি কিছুই পাইনি। আমি চাই—যা কিছু আসবে, তা যেন বউ ও আমাদের মাঝে সমান ভাগে দেওয়া হয়।’
নিহতের মৃত্যুর কিছুদিন পর স্থানীয় চেয়ারম্যান মো. সাঈদুর রহমান শহীদ নুর আলমের স্ত্রী খাদিজাকে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টাররোলে একটি চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তবে খাদিজার অভিযোগ, ‘কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সন্তানকে নিয়ে বাঁচার জন্য একটা স্থায়ী চাকরি দরকার। আমি কষ্টে আছি।’
আজ সাত মাস বয়সী সেই শিশু, যার জন্য নুর আলম প্রতিদিন খেটে মরছিলেন—তাকে বড় করার প্রতিশ্রুতি এখন একটি প্রশ্নচিহ্ন। ‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল, আমাকে ক্রিকেটার বানাবে। বোনকে ডাক্তার বানাবে। বলতো, বিকেএসপিতে ভর্তি করাবে। কিন্তু বাবার স্বপ্নগুলো এখন অন্ধকার’—বলে ছোট্ট গলায় বলে শহীদ নুর আলমের ছেলে।
নুর আলমের মৃত্যু যেন পুরো একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ কেড়ে নিয়েছে। যে সন্তান এখনো বাবার মুখ দেখতে পায়নি, তার চোখে আজ প্রশ্ন—‘আমার বাবা কোথায়?’ এখনো সন্তানকে বুকের কাছে চেপে ঘুমান খাদিজা খাতুন। বলেন, ‘ও আমাকে আব্বু কই, আব্বু কই করে ডাকে। তখন চোখের পানি আর থামে না। আমি কিছুই বলতে পারি না।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।