Image description
বাংলাদেশ - যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা » যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশের রপ্তানি মার্কিন আহন অনুযায়ী পরিচালিত হোক । » মার্কিনদের কঠিন শর্তে বাংলাদেশের আপত্তি । » বাড়তে পারে স্থগিতাদেশের সময়সীমা ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পর দেশটির সঙ্গে ‘ পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি ' নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ । এই আলোচনায় গতি থাকলেও সমঝোতার পথ সুগম হয়নি এখনো । কারণ , চুক্তি নিয়ে দুই দেশের অবস্থানের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক । ফলে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে কি না , তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে । সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন , পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি নিয়ে মূল জটিলতা সৃষ্টি করেছে দুই পক্ষের নীতিগত অবস্থান ।
 
যুক্তরাষ্ট্র চায় , বাংলাদেশের রপ্তানি মার্কিন আইন অনুযায়ী পরিচালিত হোক এবং দেশটি যদি কোনো তৃতীয় দেশের ওপর শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে , বাংলাদেশও যেন একই ধরনের ব্যবস্থা নেয় । যুক্তরাষ্ট্রের এই চাওয়া বাংলাদেশের বহুপক্ষীয় বাণিজ্যনীতি ও কৌশলগত অবস্থানের পরিপন্থী । এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে , যেসব পণ্যে তারা শুল্কছাড় পাবে , সেসব পণ্যে বাংলাদেশ যেন অন্য কোনো দেশকে একই সুবিধা না দেয় । অন্যদিকে বাংলাদেশ বলছে , এই দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয় । ঢাকা চায় , চুক্তির আওতায় দুই দেশ পারস্পরিক পণ্যে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করুক এবং কোনো পক্ষ একতরফাভাবে শুল্ক বা বাণিজ্যিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না ।

জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার । তাই আলোচনা চলছে । আমরা আলোচনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই । তবে তা কখনো জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নয় । আমরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ( ডব্লিউটিও ) সদস্য । আমাদের যা পদক্ষেপ হবে , তা ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মেনেই হবে । এই সীমাবদ্ধতা যুক্তরাষ্ট্রও জানে । '

জানা যায় , পারস্পরিক শুল্কের বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরে দুই দেশ ২৮ টি বৈঠকে বসেছে । সর্বশেষ গত ২৬ জুন ইউএসটিআর প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড . খলিলুর রহমান বৈঠক করেন । আলোচনা এখনো বন্ধ হয়নি , বরং নতুন বৈঠকের কথা রয়েছে ৩-৪ জুলাই । সেখানে অংশ নেবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনও । আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে শুল্কসীমা , ট্যারিফ শিডিউল ও আইনি ব্যাখ্যা । চুক্তির আলোচনায় ভারসাম্য আনতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু উচ্চমূল্যের পণ্যের আমদানির আশ্বাস দিয়েছে— যেমন গম , এলএনজি , বোয়িং বিমান , মূলধনি যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পণ্য । পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন পণ্যে তারা শুল্কছাড় চাইছে , তার একটি ট্যারিফ শিডিউলও চেয়েছে বাংলাদেশ । তবে এখনো সেই তালিকা পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র । বাংলাদেশের প্রস্তাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনো লিখিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি ।

তবে ঢাকার কূটনৈতিক সূত্র বলছে , যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে । এমনকি জুলাইয়ের সময়সীমা পার হলেও তারা প্রয়োজনে ৯০ দিন বা তারও বেশি সময় চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিত রাখতে পারে । তবে দুশ্চিন্তার জায়গাও কম নয় । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জানিয়েছেন , ৯ জুলাই থেকে দেশটিতে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ককাঠামো কার্যকর হবে দেশভেদে শুল্কহার নির্ধারণ করে , তা চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে । খসড়া পরিকল্পনায় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে ।

বিশ্লেষকদের মতে , যুক্তরাষ্ট্রের চাপের উৎস মূলত বাণিজ্য ভারসাম্যের বড় ব্যবধান । ২০২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার , যার মধ্যে তৈরি পোশাক ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি । বিপরীতে আমদানি মাত্র ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার — এই বিশাল রপ্তানি উদ্বৃত্ত যুক্তরাষ্ট্রের নজরে এসেছে এবং চুক্তির মাধ্যমে ভারসাম্য আনার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে তারা দেখছে ।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড . মোস্তাফিজুর রহমান বলেন , ‘ বাংলাদেশকে অবশ্যই কৌশলগত অবস্থান অক্ষুণ্ণ রেখে চলতে হবে । বাণিজ্যিক সুবিধা থাকলেও রাষ্ট্রীয় অবস্থান জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে না । যুক্তরাষ্ট্র যদি সম্পর্ক ধরে রাখতে চায় , তবে নমনীয় হবে । এ সময় দরকার সংবেদনশীল অথচ সাহসী কূটনৈতিক অবস্থান । সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো কী করছে , তার ওপর চোখ রাখতে হবে । '

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে রয়েছেন দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা । পোশাকশিল্প পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন , “ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু একতরফাভাবে শুল্ক বাড়িয়ে দিলে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে পারব না । চুক্তি হোক , কিন্তু ভারসাম্য রক্ষা করেই । সেটি ৯ জুলাইয়ের মধ্যে সম্ভব না হলে আলোচনা চালিয়ে নেওয়ার সদিচ্ছা দেখিয়ে স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরও ৯০ দিন বা তদূর্ধ্ব বাড়ানোর সময় চাওয়া হোক । ' তাই আপাতত অপেক্ষা ৩-৪ জুলাইয়ের বৈঠকের দিকে । সেখানে নির্ধারিত হতে পারে এই জটিল আলোচনার ভবিষ্যৎ — সমঝোতায় পৌঁছাবে দুই পক্ষ , নাকি সময় চেয়ে আরও এক অধ্যায়ের কূটনৈতিক লড়াই শুরু হবে ।