Image description
‘শান্তি চুক্তি’র আড়ালে সন্ত্রাসী কর্মকা- : রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়িতে অস্ত্রের মহড়া ত্রিপুরা-মিজোরামে অস্ত্রের ট্রেনিংকালে গ্রেফতার জেএসএস ক্যাডার : ভারতে বসেই কলকাঠি নাড়ছে কে এই মনোগীত জুম্ম?

‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি’ পাহাড়ে ফিরিয়ে আনতে পারেনি প্রত্যাশিত ‘শান্তি’। কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পার্বত্য জনপদে শান্তি নিশ্চিত করা এবং তাদের অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; অথচ বাস্তবে তা মুখের নিছক সস্তা বুলি। কথা রাখেনি জেএসএস। ‘শান্তি চুক্তি’র আড়ালে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অস্থিরতা চালিয়ে যাচ্ছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। সেই ‘শান্তি চুক্তি’র ২৭ বছর পরও পাহাড়ে শান্তির স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। আর এই অশান্তি ও অস্থিরতার পেছনে রয়েছে সন্তু লারমা পরিচালিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস। পাহাড়ে কাক্সিক্ষত শান্তি ও স্বস্তি প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্তু লারমার সংগঠনটি। তার কর্মী-ক্যাডার সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলি ও অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। চালাচ্ছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। অনেক ক্ষেত্রেই ওরা দুর্বিষহ করে তুলেছে শান্তিপ্রিয় পার্বত্যবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এমনকি সীমান্তের ওপারে ভারতে থাকা সন্ত্রাসীগোষ্ঠির যোগসাজশে জেএসএস ক্যাডাররা অস্ত্রের ট্রেনিং নিচ্ছে। সংগ্রহ করছে অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জেএসএসের মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তিতে ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমা দিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে আসার শর্ত ছিল। জেএসএসর সশস্ত্র ক্যাডার সংগঠন ছিল তথাকথিত সেই ‘শান্তিবাহিনী’। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সন্তু লারমার জেএসএস পদে পদে চুক্তি লঙ্ঘন করেই আরও অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করছে। এর মাধ্যমে নিজেদের সশস্ত্র সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। জেএসএসের অবৈধ সশস্ত্র সক্ষমতা বৃদ্ধি এখন শুধু পাহাড়ের নিরাপত্তার জন্যই নয়; বরং জাতীয় নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হিসেবে উদ্বেগ, শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে শান্তি চুক্তির পর সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের কারণে যে নিরাপত্তা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তার সুযোগে পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে সন্ত্রাসী ক্যাম্প এবং কথিত ‘ধর্মীয় আশ্রমে’র আড়ালে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদের ঘাঁটি। বিভিন্ন প্রত্যন্ত স্থানে হাট-বাজারে ও দুর্গম পাড়ায় প্রকাশ্যে টহল দিচ্ছে জেএসএসের অস্ত্রধারী সন্ত্রসীরা। যা সুস্পষ্ট চুক্তি লঙ্ঘনের শামিল।

গত ২৬ জুন রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে জেএসএস ক্যাডাররা। এতে শুধু ভীতিকর অবস্থা তৈরি শুধু নয়; বরং তরুণ শিক্ষার্থীদের বিপথে ঠেলে দেয়ার ধ্বংসাত্মক অপচেষ্টা বলে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। তাছাড়া গত ৩০ জুন এবং গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি ও দীঘিনালা উপজেলায় জেএসএসের সশস্ত্র সংঘর্ষ, গোলাগুলিতে পাহাড়ি জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের এই আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে স্থানীয়দের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এসব কর্মকা- থেকে প্রমাণিত হয়, তারা পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসকে আরো পাকাপোক্ত ও আধিপত্য কায়েম করতে চায়। যাতে করে সেখানে প্রশাসন বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি যেন নিষ্ক্রিয় ও অপ্রয়োজনে পরিণত হয়।

জেএসএসের সশস্ত্র সন্ত্রাসের ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দারা আলাপকালে জানান, এখানে-সেখানে সন্ত্রাসীরা গোলাগুলি ও হামলা চালায়। আমরা ভয়-ভীতিতে আছি, হঠাৎ কখন কার ওপর হামলা হয়। এজন্য আমাদের কোথাও কাজেকর্মে যেতে গেলেও ভয় পাই। সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে এরমধ্যে নিরীহ এক মহিলাও গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা নিরীহ মানুষ, আমরা সন্ত্রাস নয়; শান্তি চাই। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে তাদের আয়-রোজগারও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান।

এদিকে সীমাতের ওপারে ভারতে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সাথে যোগসাজশে জেএসএসের অস্ত্র ট্রেনিংসহ বিভিন্ন তৎপরতা চলছেÑ তা সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় সুস্পষ্ট। যেমন- গত ১২ ফেব্রুয়ারি’২৫ইং ভারতের মিজোরামের লুংলাইতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রসহ তিনজন জেএসএস সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়; যাদের সঙ্গে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের যোগাযোগ ছিল। তাছাড়া গত ৩ জুন ত্রিপুরার আগরতলায় ১৩ জন জেএসএস ক্যাডারকে আটক করা হয়। জানা গেছে, তারা ‘চিকিৎসা’র নামে ওপারে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। গতবছর’২৪ সালের জানুয়ারিতে মিজোরামে ৭শ’ জন জেএসএস সদস্যেকে প্রশিক্ষণ করানো হয়, যা দেশটির কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নজরে আসে।

বিশ্বস্ত বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) অন্যতম এক শীর্ষনেতা ভারতে বসেই নাড়ছেন কলকাঠি। মনোগীত জুম্ম নামের ওই ব্যক্তি এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন। মনোগীত জুম্ম’র আসল নাম করুনালংকার ভান্তে। ধর্মীয় বেশভূষায় নিজেকে ‘বৌদ্ধ ভিক্ষু’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। বাস্তবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ-সভাপতি এবং তথাকথিত ‘জুম্মল্যান্ড’-এর স্বঘোষিত নেতা। তিনি মূলত একজন বিভাজনবাদী এবং ধর্মকে অপব্যবহার করছেন রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ঢাল হিসেবে।

নিজের বিভিন্ন অপকর্মের কারণে নিজ জন্মস্থান খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ছেড়ে ভারতের দিল্লিতে বসবাস করছেন। মনোগীত জুম্ম ওরফে করুনালংকার ভান্তের ধর্মীয় বেশভূষার আড়ালে মদ্যপানের ছবিও পাওয়া গেছে। দিল্লি ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বসে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বোডো গেরিলা বাহিনীর কাছ থেকে ৪১টি গ্রেনেড বাংলাদেশে এনে জেএসএসের কাছে হস্তান্তর করেন এই মনোগীত জুম্ম ওরফে করুনালংকার ভান্তে। গত ৩ মে’২৫ইং জেএসএস নেতা সন্তু লারমা ‘চিকিৎসা’র নামে দিল্লিতে গিয়ে মনোগীত জুম্মর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। এটি ভবিষ্যতে আরেক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিতবাহী বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

এদিকে পার্বত্য জনপদে জেএসএসের সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপতৎপরতা ও এর দমন প্রসঙ্গে তিনটি পার্বত্য জেলা যথাক্রমেÑ রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ ও পুলিশ সুপার মারুফ আহমেদ, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এবিএম ইরতেখার ইসলাম খন্দকার ও পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল এবং বান্দরবান জেলা প্রশাসক শামীম আরা রীনি ও পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাওছার বিভিন্ন মিডিয়াকে জানান, মানুষের জীবনযাত্রা সচল রাখা ও উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা।

তারা জানান, পার্বত্য এলাকার কোথাও যখনই সন্ত্রাসী কার্যকলাপের খবর পাওয়া আসে, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। পুলিশ, বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে সেনাবাহিনী মিলিয়ে যৌথ ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় সন্ত্রাসীদের অবৈধ কর্মকা- কঠোরভাবে প্রতিহত করা হয়। পর্যটন এলাকাগুলোতেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পাহাড়ের সাধারণ জনগণ চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও স্বস্তি। প্রশাসন এ বিষয়ে সর্বদা সজাগ রয়েছে। জনসাধারণের আইন-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা বিধানে প্রশাসন বদ্ধপরিকর।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসর পরিকল্পিত সন্ত্রাসী অপতৎপরতায় গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করে বলেছেন, অনতিবিলম্বে জেএসএসের এহেন সন্ত্রাসী কর্মকা- সমূলে উৎপাটন করে কঠোরহাতে রুখে দিতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে শুধুই পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়; সার্বিকভাবে দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। জেএসএসের অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের আটকের মাধ্যমে পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই বলেই তারা অভিমত দিয়েছেন।