Image description

বাংলাদেশের যে বিভীষিকাময় ঘটনা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই হোলি আর্টিজান হামলার বর্ষপূর্তিতে দেশে কোনো জঙ্গি দেখছেন না ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।

তার ভাষায়, “বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নাই। বাংলাদেশে আছে ছিনতাইকারী।”

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশান-২ এ হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় বাংলাদেশেরই পাঁচ তরুণ। গুলি চালিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে তারা হত্যা করে।

নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানের, একজন ভারতীয়, দুজন বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক ছিলেন। এর বাইরে হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে একদল তরুণের ওই আত্মঘাতী হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি। সেই রাতেই এর দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএস।

তবে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা নাকচ করে সে সময় বলেন, বাংলাদেশি জঙ্গিদের একটি সংগঠিত ধারাই এই হামলা চালিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নব্য জেএমবি’।

এখন, রাষ্ট্র ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর খোদ পুলিশ বাহিনীর মধ্যেই জঙ্গিবাদ নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে।

গেল বছরের এই দিনে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) তৎকালীন প্রধান আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর জঙ্গি দমনে সফলতা এলেও এর বীজ রয়ে গেছে।

এক বছর বাদে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জঙ্গি দমনে এখন কোনো উদ্যোগ তাদের আছে কি না।

জবাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জঙ্গি নাই, এখন ঠেকাতে হবে ছিনতাই। জঙ্গি থাকলে না জঙ্গি নিয়ে ভাবব।”

ডিএমপি কমিশনার বলেন, “আওয়ামী লীগের সময় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ছেলেপেলেদের মারছে, কিসের জঙ্গি?”

হোলি আর্টিজান হামলা কি তাহলে সাজানো ঘটনা ছিল?

এমন প্রশ্নের উত্তরে সাজ্জাত আলী বলেন, “ওটা সম্পর্কে আমি জানি না; তবে বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নাই। বাংলাদেশে পেটের দায়ে লোকে ছিনতাই করে।”

 

হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় জিম্মি করা মানুষদের উদ্ধারে গিয়ে প্রাণ হারানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। ২০২৪ এর অগাস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার দিনটিকে স্মরণ করে প্রতি বছর গুলশান থানায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’-এ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাতেন ঊধ্বর্তন পুলিশ কর্মকর্তারা।

গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের যে বাড়িটিতে বেকারিটি ছিল, সেই ৫ নম্বর বাড়িতে প্রতি বছরের ১ জুলাই ইতালি, জাপান ও মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধা জানানোর রেওয়াজ চালু হয়েছিল।

তবে এবার এ ধরনের কোনো কর্মসূচি নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান।

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অধিকাংশ থানায় হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার খবর আসতে থাকে। এর মধ্যে গুলশান থানার ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’ গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের পোস্টার লাগানো হয়।

কখন বা কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা নিয়ে গত বছরের অগাস্টের অস্থির সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে কেউ বক্তব্য দেয়নি।

গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে চলে আসে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর। হোলি আর্টিজান বেকারির সামনে স্থাপন করা ভাস্কর্য ভাঙার পর নিষিদ্ধ সংগঠনটির পোস্টার সাঁটানো হয়।

হোলি আর্টিজানে যখন হামলা হয়, তখন রোজার মাস চলছিল। ঘটনার রাতটি নির্ঘুম কাটে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংবাদ কর্মীসহ কোটি কোটি মানুষের। নজিরবিহীন সেই রাতে সবার চোখ আটকে ছিল টেলিভিশনের পর্দায়।

ভেতরের পরিস্থিতি জানতে এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা পরিকল্পনা চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেন। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় সেনাবাহিনী ডাকা হয়। পরদিন সূর্য ওঠার আগে শুরু হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান।

সেই অভিযানে হোলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ নেয় কমান্ডোরা, পাঁচ জঙ্গির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রুদ্ধশ্বাস সংকটের অবসান ঘটে।

নিহত সেই ৫ জঙ্গি হলেন– নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।

ধীরে ধীরে জানা যায়, হোলি আর্টিজানে হামলার বেশ কিছুদিন আগেই তারা বাসা থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তাদের কারো কারো পরিবার থানায় জিডিও করেছিল।

গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় ওই ঘটনা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। দেড় ডজন বিদেশি নাগরিক নিহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও বড় পরিসরে সেই খবর প্রকাশ করে।

হোলি আর্টিজেন হামলার পর গুলশান থানায় দায়ের করা মামলার বিচার চলে প্রায় সাড়ে তিন বছর। পুলিশ ওই ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে।

২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সাতজনের ফাঁসির রায় দেয়।

কিন্তু ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ে ওই সাতজনের সাজা পাল্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় হাই কোর্ট।

দণ্ডিতরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।

ওই ঘটনার দেড় দশক আগে থেকেই জঙ্গিবাদ দমনে তৎপর ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু হোলি আর্টিজানের মত এক বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তার কোনো আভাস, কোনো বাহিনীর কাছে ছিল না।

সে কারণে ওই ঘটনার পর জঙ্গি দমন কার্যক্রম ঢেলে সাজানো হয়। র‌্যাবের বিশেষ উইং, ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি ছাড়াও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট নামে পুলিশের আলাদা বিভাগ জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করছিল।

জঙ্গি দমনে গঠিত ডিএমপির বিশেষ ইউনিট সিটিটিসির বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, “তাদের বলে দেওয়া হয়েছে- ‘বাংলাদেশে জঙ্গি নাই, ফলে জঙ্গি ধরা লাগবে না। ছিনতাইকারি ধরে নিয়ে আস, ওরাই আমাদের জঙ্গি।”

গত দেড় দশকে শত শত গুমের অভিযোগ অনুসন্ধানে গঠিত গুম সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনও বলেছে, জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের ছায়ায় ইসলামী উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গুমকে ‘একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ দিয়েছিল।

তবে সন্ত্রাসবাদের হুমকি যে মিথ্যে নয়, সে কথা স্বীকার করে কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম গত ১৯ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজানে হামলার মত ঘটনা এর প্রমাণ। তবে, এই হুমকি মোকাবেলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।”