
দীর্ঘদিন পর বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণে কিছুটা জট খুলেছে। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ এগিয়ে নিতে সম্প্রতি ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। প্রকল্প অনুমোদনের ছয় বছর পর এ বরাদ্দ মিলল। তবে প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়নে এখনও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। কারণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে অর্থায়নের প্রধান অংশীদার ভারত গত পাঁচ বছরে এক টাকাও ছাড় দেয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফে বিকল্প অর্থায়নের উৎস খোঁজার প্রক্রিয়া জোরেশোরে চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চীন ও জাপানের পাশাপাশি কয়েকটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গেও প্রাথমিক আলোচনা চলছে, যাতে প্রকল্পটি সময়মতো বাস্তবায়ন করা যায়।
২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ‘বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ’ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের পরিধি ও খরচ বেড়ে এখন তা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের ৩০ জুন। সেই হিসাবে প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আর এক বছর।
রেলপথটি নির্মাণ হলে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ থেকে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াতের সময় কমবে প্রায় চার ঘণ্টা। দূরত্ব কমবে ১১২ কিলোমিটার। এতে উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও শিল্পপণ্য এবং যাত্রী পরিবহনে নতুন গতি আসবে।
বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৯০০ কোটি টাকা খরচ হবে বগুড়া অংশে, বাকিটা সিরাজগঞ্জ অংশে। তবে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি এম ইমরুল কায়েস বলেন, বগুড়া অংশে ভূমি অধিগ্রহণে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা চাহিদা ছিল।
ভারতের ফাঁকা প্রতিশ্রুতি
বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ প্রকল্পটি শুরু থেকেই ভারতের অর্থায়ননির্ভর ছিল। ২০১৮ সালে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে প্রায় ৩৭৯.২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (প্রায় ৪৪০০ কোটি টাকা) ঋণচুক্তি হয়। এ অর্থ ভারতের দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বরাদ্দ থাকার কথা ছিল।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ে সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা, পরামর্শক ও জমি জরিপের কাজ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে ভারতের সঙ্গে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে ভারতের এক্সিম ব্যাংককে পাঁচবারের বেশি চিঠি পাঠানোর পাশাপাশি প্রকল্পের দরপত্রসহ প্রয়োজনীয় নথিপত্র সরবরাহ করা হয়।
তবে দীর্ঘ পাঁচ বছরেও ভারত অর্থ ছাড় দেয়নি। এক্সিম ব্যাংক বারবার অজুহাত দেখায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তারা ‘সম্মত নয়’ এমন কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। যেমন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান। বাংলাদেশ সরকার চায় বিশ্বব্যাংকের মতো উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে দরপত্র দিতে, যা ভারতের শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত চায় তাদের দেশের ঠিকাদারকে প্রাধান্য দিতে। আর বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান ছিল উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পক্ষে। এই মতবিরোধ প্রকল্পের অর্থ ছাড় প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে।
এদিকে ভারতের দিক থেকে নীরবতা এবং সময়ক্ষেপণের কারণে প্রকল্পের সময়সীমা ও খরচ দুই-ই বেড়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ও রেলপথ বিভাগ এখন বিষয়টি ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিশ্রুতি’ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে গত বছরের শেষ দিক থেকেই সরকার কার্যত ভারতীয় অর্থায়নের বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নতুন অর্থদাতা খোঁজার কৌশল নিয়েছে। চীন, জাপান, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে জাইকার সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের একাধিক বৈঠক হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র। পাশাপাশি চীনা এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকেও প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে।
এদিকে, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ যৌথভাবে সম্ভাব্য বিকল্প অর্থদাতাদের জন্য একটি ‘পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রোফাইল’ তৈরি করছে। সেখানে প্রকল্প খরচ, সময়সীমা ও অগ্রগতি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত করে দাতা সংস্থাগুলোর কাছে জমা দেওয়া হচ্ছে।
প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা
এখন বগুড়া থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। রেলপথ চালু হলে তা ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এখন উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সড়কপথে ঢাকায় নিতে বেশি সময় লাগছে। যানজটসহ বিভিন্ন কারণে পণ্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও থাকছে। নতুন রেলপথে সাশ্রয়ী পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হলে একদিকে যেমন পরিবহন খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমবে, তেমনি পণ্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও কমে আসবে।
বগুড়ার পরিবহন ব্যবসায়ী মজিবর রহমান বলেন, রেলে সবজি গেলে খরচ কমবে, সময়ও বাঁচে। অনেক সময় ট্রাকে ঢাকায় পৌঁছাতে দেরি হলে সবজি পচে যায়। এখন যদি ট্রেন চলে, আমরা আরও ভালো দাম পাব, লোকসান কমবে।
এ রেলপথ ঘিরে ৯টি নতুন স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ায় চারটি ও সিরাজগঞ্জে পাঁচটি। এ ছাড়া বগুড়ার রানীরহাট ও সিরাজগঞ্জ সদরে দুটি নতুন জংশন স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে; বাড়বে যাতায়াতের সুবিধা।
রেলওয়ে পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, উত্তরাঞ্চলকে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করে একটি নতুন ‘আর্থসামাজিক করিডোর’ তৈরি করবে এই রেলপথ।
প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, অর্থ বরাদ্দ মেলায় এখন অধিগ্রহণ করা জমির দাম পরিশোধ শুরু করা হবে। তবে প্রকৃত কাজের অগ্রগতি নির্ভর করছে মূল প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার ওপর।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, এ রেলপথ নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের অন্তত আট জেলা উপকৃত হবে। এ অঞ্চলের চেহারাই পাল্টে যাবে।