২০১৬ সালে গুমের শিকার পারভেজ হোসেনের একমাত্র মেয়ে হৃদি। হৃদির বয়স ছিল তখন দুই বছর। আজ সে ১১ বছরের কিশোরী। হৃদি বলছিলেন, আমার বাবার কী দোষ ছিল যে, তাকে গুম করা হলো। আজও ফিরে এলো না আমার বাবা। আমরাই বা কি দোষ করেছিলাম, যার কারণে এখনো বাবাকে ফেরত পাইনি। আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই।
এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে হৃদি। তার কান্নায় উপস্থিত সকলের চোখ ছলছল করছিল। হৃদি বলে, ফিরিয়ে দাও আমার বাবাকে। আমার বাবাকে ফেরত চাই। আমি শুধু বাবার হাতটা ধরতে চাই। গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বিগত ১৫ বছরে গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিরা শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবি তুলেছেন। জুলাই আন্দোলনে ডান পা হারিয়েছে ১৫ বছরের টগবগে কিশোর মো. তামিম। তামিম বলে, ৫ আগস্ট বিকাল ৪টার দিকে বিজয় মিছিলে বের হই। মিরপুর মডেল থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় থানা থেকে বের হয়ে কিছু পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে। তখন আমার পায়ে গুলি লাগে। তার আগে, ১৮ জুলাই মিরপুর-২ নম্বরে আমি ছড়রা গুলির শিকার হই।
তিনি বলেন, সবাই বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা ছিলেন। কিন্তু আমরা যারা আহত ছিলাম তাদের কেউ খোঁজ নিচ্ছিলেন না। প্রথমে মিরপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি হই। সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর সেখানে পচন ধরলে পা কেটে ফেলতে হয়। এরপর হতাশায় ডুবে ছিলাম। কিন্তু ব্র্যাক থেকে যখন কৃত্রিম পা লাগানো হলো তখন মনে সাহস পেলাম। এখন আমি নিজে নিজে চলতে পারি। এখন স্বপ্ন দেখছি, লেখাপড়া চালিয়ে যাব। দেশের জন্য কাজ করতে চাই।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেছিলেন জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ হারানো ২১ বছরের উড়ন্ত যুবক ওমর ফারুক। তিনি বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেক্ট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ সেমিস্টারে পড়তেন। জুলাই আন্দোলনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে গাজীপুরের সখীপুরের নিজ বাড়িতে ছিলেন। ৪ আগস্ট প্রবল আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন ওমর ফারুক। আনসার একাডেমির সামনে বিকাল ৪টার দিকে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা মিলে গুলি ছুড়তে থাকে। তখন পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হন তিনি। এর পর তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। ওমর ফারুকের ছোট ভাই ফরহাদ ইসলাম বলেন, হাসপাতালে যাওয়ার পর দেখি তার পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শুধু গুলি আর গুলি। ডাক্তার জানায়, দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের বাবা রিকশা শ্রমিক আর মা গৃহিণী। বড় ভাই পড়ালেখা করে কিছু একটা করবেন সেই আশা ছিল। কিন্তু সেটা মুহূর্তেই ধুলিসাৎ। চোখ হারানোর পর সারজিস আলম সাক্ষাৎ করে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এর পর জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। আর চিকিৎসা সেবা সরকারিভাবে করা হচ্ছে। হৃদি, ওমর ফারুক ও তামিমের মতো শত শত গুম খুনের শিকার ও জুলাই আন্দোলনে আহতরা উপস্থিত হয়েছেন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে উপস্থিতদের একটাই দাবি, শেখ হাসিনাকে দেশে এনে আদালতের মাধ্যমে বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি কার্যকর করা। পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িতদেরও বিচারের দাবি জানান তারা।ইনকিলাব