
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিল্প মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১০ বছরে বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন শীর্ষপদে থাকা কর্মকর্তারা। অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন, ওই সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা পাঁচ সচিব।
এ সময়ে দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁঞা, সাবেক সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, সাবেক সচিব আব্দুল হালিম, সাবেক শিল্প ও জনপ্রশাসন সচিব কেএম আলী আজম এবং সর্বশেষ জাকিয়া সুলতানা (বাধ্যতামূলক অবসর)। তারা কাফকোর চেয়ারম্যান থাকাকালে বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে লভ্যাংশও নিয়েছেন। তৎকালীন সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ৫০ শতাংশ কম মূল্যে কাফকোকে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জ্বালানি সুবিধা দিয়েছেন। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার সুবিধাও নিয়েছেন তারা।
নামমাত্র মূল্যে দেশের গ্যাস ও জ্বালানিতে মুনাফা হলেও সেটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে চলে যায়। এসব মুনাফা ডলারে পাঠানো হয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার সংকট চলছে। কিন্তু সদ্য সাবেক শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা ও তার আগে চার সচিবের যোগসাজশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশের টাকা নিয়ে গেছেন। বিনিময়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়েছেন। সাবেক সচিবরা ছিলেন তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি করলেও সবসময় থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখানে সচিবের দায়িত্বে থাকা এক আমলা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সংস্থায় চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার তাকে পুরস্কার হিসেবে ওই পদে নিয়োগ দেন বলেও আলোচনা রয়েছে।
গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। দুদক শিগগির এ বিষয়ে জোর তদন্ত করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীর প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা পূর্বে দায়িত্বে থাকা সচিবদের মাধ্যমে অনিয়ম হয়েছে কি না তা তার জানা নেই।’ তবে তিনি জানিয়েছেন, ‘এ বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন।’
প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা গেছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই আমলাকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (কাফকো) পদাধিকারবলে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কাফকোতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। জাকিয়া এবং তার আগের চারজন শিল্প সচিবের মদদে কাফকোর পৌনে ৭ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে নিয়ে গেছে বিদেশি বিনিয়োগকারী চার প্রতিষ্ঠান। অনৈতিক সুবিধা নিয়েই তারা দেশের এ বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে চলে যেতে সহায়তা করেছেন। এ-সংক্রান্ত সব প্রমাণপত্র রয়েছে। তবে জাকিয়া সুলতানা তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন।
কাফকোর ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘অন্যায়ভাবে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে বদলি, অনিয়মের মাধ্যমে করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিট বা সিএসআর ফান্ড আত্মসাৎ, জুম মিটিংয়ের জন্য অস্বাভাবিক সম্মানী গ্রহণ এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ না দিয়েই নিজেই সেই পদের বেতন-ভাতা ভোগসহ নানা অনিয়ম করেছেন সাবেক সচিব জাকিয়া সুলতানা।’ ২০২১ সালের মে মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েই একের পর এক অনিয়মে জড়ান তিনি। বাংলাদেশ সরকার ও বিদেশি মালিকানায় পরিচালিত কাফকোতে চেয়ারম্যান পদের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সিইওর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। সিইও নিয়োগ দিতে কাফকোর বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলেও তিনি তা বাস্তবায়ন করেননি। সিইওর বেতনের পৌনে ৪ লাখ টাকা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার উদ্দেশ্যেই জাকিয়া বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে হাঁটেননি। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি।
নানা অনিয়ম ও ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী এসব সচিব ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তার পাসপোর্ট বাতিল করে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।
৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা বিদেশিদের পকেটে
কাফকো বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে গ্যাস, অবৈধ শুল্কছাড় এবং নিম্ন আয়কর (৫০%) সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন সচিবরা। এটি বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থি। এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় একাধিকবার আপত্তি জানালেও এসব সুবিধা বন্ধ করা যায়নি। সরকারি সুবিধা নিয়ে মুনাফা করার পর সে টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শত শত কোটি টাকা নিজের পকেটে নিয়েছেন সচিবরা। তাদের এ সুবিধা দিতে তৎপর ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিসিআইসির চেয়ারম্যানরা। ডিভিডেন্টের নামে ২০১২ সালের জুন থেকে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা নিয়ে গেছে বিদেশি বিনিয়োগকারী চার প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে মারুবেনি ও চিয়োদা ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি, সাইফা ও টপশো ১ হাজার ৭১৪ কোটি, আইএফইউ ১ হাজার ১৮৯ কোটি এবং স্টেমিকার বন ১৮৫ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ‘গত ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড থেকে কাফকোকে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্যহার শিল্পশ্রেণির জন্য নির্ধারিত মূল্যহার অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু কাফকো পূর্ববর্তী মূল্যহার প্রতি ঘনমিটার মাত্র ১৪ টাকা করে পরিশোধ করে আসছে। ফলে মূল্যহার বাড়ানোর পর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের কাছে কাফকোর বকেয়া পড়েছে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কাফকোর চেয়ারম্যান ও সিইও হিসেবে এ বকেয়া পরিশোধের কোনো উদ্যোগই নেননি সচিব।’
এ বিষয়ে সম্প্রতি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো সাবেক শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা কোম্পানি ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলতে পরামর্শ দেন। তবে এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেন এত টাকা নিয়ে গেল সেটি তার জানা নেই বলেও জানান। এ ছাড়া অন্য সচিবদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।