
কেউ ছিলেন অল্প দিন আগেও মন্ত্রী। কেউবা ছিলেন প্রভাবশালী এমপি। কেউ আবার সাধারণ নাগরিক। কিন্তু কারাগারে বন্দি হিসেবে এখন তারা যেন সবাই সমান। বিশেষ করে রমজানের ইফতারিতে তারা মিলে গেছেন এক কাতারে। কারা কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা নির্দিষ্ট ইফতারসামগ্রী সবার জন্য একই ভাবে বরাদ্দ। আলাদা বা কোনো ভিন্নতা নেই।
একসময় প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি বা নেতা হিসেবে যারা ‘ভিআইপি প্রটোকল’ নিয়ে চলাফেরা করতেন, তারা এখন সাধারণ বন্দিদের সঙ্গেই ইফতার করছেন। কারা অভ্যন্তরে এখন ভিআইপি আর সাধারণ বন্দির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
গত বুধবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, কাশিমপুর ও চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি কারাগারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
কারা অধিদপ্তর খবরের কাগজকে জানিয়েছে, রমজান মাসজুড়ে প্রতিদিন রোজাদারদের তালিকা করে কর্তৃপক্ষ। সব বন্দির জন্যই পানি থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। ভিআইপি ও সাধারণ বন্দিদের একই ধরনের খাবার দেওয়া হয়। ইফতারে থাকে খেজুর, ছোলা, মুড়ি, কলা, পেঁয়াজু, জিলাপি, চিড়া, গুড় ও চিনির শরবত। এই সময়টায় খুবই সুশৃঙ্খলভাবে চলে সবকিছু। প্রত্যেককে পৃথকভাবে এই ইফতারি সরবরাহ করা হয়। শরবতসহ এই ৯ পদের খাবার দিয়ে প্রতিদিনই ইফতার করেন বন্দিরা।
এ ছাড়া কারাগারের ভেতরে রয়েছে ক্যানটিন। সেখানে ইফতারের জন্য আলু-ডিম চপ, বেগুনি, বুন্দিয়া ও পেঁয়াজু পাওয়া যায়। এ ছাড়া আপেল, কমলা, মাল্টা, আনারস ও তরমুজসহ বিভিন্ন ধরনের ফল পাওয়া যায় এই ক্যানটিনে। ভিআইপি বন্দিদের অনেকেই ইফতারে ফল খেতে পছন্দ করেন বলেও জানায় একটি সূত্র। অনেক সময় ক্যানটিন থেকে বাড়তি খাবার অনেকে কিনে খেয়ে থাকেন।
কারা অধিদপ্তর আরও জানায়, ইফতারের পরে রাতের খাবার ও সাহরিতে দেওয়া হয় গরম ভাত, মাছ, মাংস (গরু, মুরগি, খাসি) সবজি ও ডাল। এখানে ভিআইপি বন্দিরা দুবেলা মাছ-মাংস পেলেও সাধারণ বন্দিরা এক বেলা মাছ ও মাংস পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া কোনো কোনো কারাগারে সাধারণ বন্দিদের ডিম দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. জান্নাত-উল ফরহাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘কারাগারে ভিআইপি ও সাধারণ বন্দিদের ইফতারের পদে কোনো ভিন্নতা নেই। সবাইকে একই ইফতারি দেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘কোনো বন্দি বাড়ি থেকে কারাগারে খাবার আনতে পারেন না। আগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাবার আনার বিষয়টি বিবেচনায় রাখলেও এখন পুরোপুরি বন্ধ। এ ছাড়া কারাগারে ক্যানটিন রয়েছে। সেখানে হরেক রকম ফল ও ইফতারের বাহারি আইটেম থাকে। কেউ চাইলে কিনে খেতে পারেন।’
আলাপকালে তিনি আরও জানান, পবিত্র রমজান মাসে কারাগারে বেশির ভাগ মুসলিম বন্দি রোজা রাখেন। ব্যস্ত থাকেন ইবাদত-বন্দেগিতে। নামাজ আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আসর পর্যন্ত বন্দিরা এক কাতারে নামাজ আদায় করেন। ইফতারের পরে মাগরিব ও তারাবির নামাজ নিজ নিজ কক্ষে আদায় করেন।
কারাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, সারা দেশে মোট কারাগারের সংখ্যা ৬৮টি। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগার। এসব কারাগারে সব মিলে বন্দি ধারণক্ষমতা মোট ৪২ হাজার ৫৯০ জন। তবে এসব কারাগারে প্রায় সময়ে ৬৫ হাজারের বেশি বন্দি থাকেন। এর মধ্যে কেউ এক দশক, কারও দুই দশক, কেউবা আরও বেশি সময় ধরে বন্দি আছেন। শেষ কবে পরিবারের সঙ্গে ইফতারি করেছেন তাও অনেকের মনে নেই। ইচ্ছা থাকলেও সাধ্য নেই জেলের সীমানা প্রাচীর পাড়ি দিয়ে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করার। কিন্তু দেহটা বন্দি থাকলেও মনটা পড়ে থাকে প্রিয়জনদের কাছে, পাশাপাশি রয়েছে নানা বঞ্চনা ও যন্ত্রণা। চাইলেও তারা বাড়ি ফিরতে বা পরিবারে সঙ্গে ইফতার করতে পারেন না। তবে রমজান মাস কোনো রকমে কেটে গেলেও ঈদের দিন তারা কেউ কেউ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত কারাগারে একজন বন্দির স্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই কষ্টের কথা বলার ভাষা নেই। প্রায় ৭ বছর ধরে তিন সন্তান নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। ফোন করলে ওপাশ থেকে শুধু কান্নার আওয়াজ আসে। এ ছাড়া চাঁদ রাত এলেই ছেলেমেয়েরা কাঁদতে থাকে।’