
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আগামী মাসেই এ-সংক্রান্ত পৃথক দুটি প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় দাখিল করার কথা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আওতায় গঠিত তদন্তকারী সংস্থা ও প্রসিকিউশনের সমন্বয়ে বৈঠকে গত সপ্তাহে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় চিফ প্রসিকিউটর ও তদন্তকারী সংস্থার প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় চলতি মাসের মধ্যে তদন্ত সংস্থাকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে এক-তৃতীয়াংশ কাজ বাকি।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকে নানা ধরনের অপরাধের প্রধান হিসেবে বিচারের প্রথম ধাপে শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সরাসরি নির্দেশদাতা হিসেবেও থাকছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার পৃথক দুটি প্রতিবেদন শিগগিরই প্রসিকিউশন বিভাগে দাখিল করবে তদন্তকারী সংস্থা।
এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যাচাই-বাছাই করে একটি অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠন করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্রথম কোনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে আশ্রয়ে রয়েছেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর শেখ হাসিনা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান হিসেবে সবকিছুই তাঁর একক নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে। এখানে তাঁকে ‘সুপিরিয়র কমান্ড’ হিসেবে রাখা হচ্ছে।
তবে তদন্ত সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। স্বল্প সময় ও তাড়াহুড়া করে দুর্বল প্রতিবেদন দাখিল করা হলে আসামিরা বেরিয়ে যেতে পারেন।
দাখিল করতে যাওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৫ বছর শাসনামলে সব ধরনের অপরাধ, দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, আয়নাঘর বানিয়ে নির্যাতন, পুলিশ ও র্যাবকে রাষ্ট্রের দানব বানিয়ে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে– সেসব বিষয় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। পাশাপাশি জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ দিনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাদের একটি শ্রেণিতে এবং যারা এসব অপরাধ করতে নির্দেশ, উস্কানি ও প্ররোচনা দিয়েছে– তাদের দ্বিতীয় একটি শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনে গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন দপ্তরের তথ্যানুসন্ধানে প্রকাশিত ১২৭ পৃষ্ঠার জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর কয়েকটি প্রতিবেদনও সংযুক্ত করা হবে। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে মারণাস্ত্র দিয়ে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, চিকিৎসা পেতে বাধা দেওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে সরকারের বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করার সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আগে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা হয়। তবে এ মামলার সাক্ষী হিসেবে আড়াইশ থেকে তিনশ ব্যক্তিকে রাখা হচ্ছে। সাক্ষীদের মধ্যে ভিকটিম, শহীদ পরিবারের সদস্য, প্রত্যক্ষদর্শী, গণমাধ্যমকর্মী, ডিজিটাল প্রমাণ, ফুটেজ, সিসিটিভি ফুটেজ, টেলিফোন কথোপকথনসহ অন্য যাবতীয় সাক্ষ্যের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে।
চার শতাধিক পৃষ্ঠার ভলিয়মে তৈরি করা তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, জুলাই-আগস্টে সারাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পরিদর্শন করে এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলে নতুন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া সাধারণ ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে সরকার ও তাদের দোসর সহযোগী কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের কাটিং, সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদন সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট ধারায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে প্রতিবেদনটি প্রথমে প্রসিকিউশন বিভাগে দাখিল করা হবে। এর পর প্রতিবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিফ প্রসিকিউটর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণের পর ট্রাইব্যুনাল যাচাই-বাছাই করে অভিযোগ গঠন করবেন। তার ওপর ভিত্তি করেই হবে অপরাধের বিচার। এর পর মামলার আসামি পলাতক থাকলে ট্রাইব্যুনাল আইনের দৃষ্টিতে হাজির হওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দেবেন। তাতেও সাড়া না পেলে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। ওই বিজ্ঞপ্তি বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে পলাতক আসামির ঠিকানা অনুযায়ী বাড়ির গেটে টানিয়ে দেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসামি হাজির না হলে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ শুরু করার নির্দেশ দেবেন ট্রাইব্যুনাল। সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে প্রথম মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার। বিচারে সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দাখিল করা তথ্য-উপাত্তে দোষী সাব্যস্ত হলে সাজা হবে অভিযুক্তদের।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর পর তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশে থানা ও আদালতে হত্যা, গণহত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যাসহ তিন শতাধিক মামলা এবং তাঁর মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, সরকারের সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নৃশংস হত্যার অভিযোগে মামলা করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই মাস পর ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ট্রাইব্যুনালে শুনানিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রসিকিউশনকে তিনবার সময় দেওয়া হয়। আগামী ১৮ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তাঁর সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর মধ্যে গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাকে একক আসামি করে একটি মামলা এবং শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হকসহ ৪৬ জনকে আসামি করে অপর মামলাটি করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগ।
প্রতিবেদন দাখিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কয়েকটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তদন্ত সংস্থা দিনরাত কাজ করছে। তারা জানিয়েছে, এ মাসের মধ্যেই কয়েকটি মামলার প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে আমরা আশা করছি, শিগগিই প্রতিবেদনগুলো পেয়ে যাব।