
গুলশানের লেকপাড় এলাকার বাসিন্দা নাহিদ হাসান একটি অ্যাপার্টমেন্টের ছয়তলায় থাকেন। সেখানে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। বললেন, ‘মশা দিনের বেলায়ও গুনগুন করে। ছয়তলার ফ্ল্যাটে দরজা-জানালা বন্ধ করলেও মশার যন্ত্রণায় দিনের বেলায় স্প্রে করতে হয়। তার পরও মশার গান থামে না।’
পল্লবীর রূপনগর এলাকায় মুদি দোকান করেন মফিজুর রহমান। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। সমকালকে তিনি বলেন, ‘সকালে দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। তার পরও নিস্তার নেই। অবস্থাটা এমন, যেন কয়েলের ওপরেই মশা বসে থাকে।’
পল্লবীর আরেক বাসিন্দা বিকাশ চন্দ্র রায় বলেন, বিকেল হতেই মশা জেঁকে বসে। সাততলার ওপরেও মশা। মশক কর্মীদের এখন তেমন দেখাই যায় না।
বস্তি এলাকার চিত্র আরও খারাপ। কড়াইল বস্তির রাসেল মিয়া বলেন, ‘শীত শেষ হতেই মশার যন্ত্রণা বেড়েছে। দিনে মশা। যখন সাহ্রি খাইতে উঠি, তখনও মশা। বস্তিতে তো কয়েল সব সময় লাগানো যায় না; কখন কী হয়! তাই ঘরে থাকলে মশারির মধ্যেই থাকতে হয়।’
রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার চিত্র এমনই। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর, মাণ্ডা, মুগদাপাড়া, খিলগাঁও, পুরান ঢাকার কিছু এলাকা, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আদাবর ও রামপুরার পরিস্থিতি বেশি খারাপ।
রাজধানীতে ভয়াবহভাবে মশার উৎপাত বাড়লেও দুই সিটি কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। কার্যকর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। রাজধানীর মালিবাগ এলাকার গুলবাগের বাসিন্দা রোকন মিয়া বলেন, ‘আগে মশার ওষুধ না দিলে কাউন্সিলর অফিসে যাইতাম। এখন মশার ওষুধ দেয় না। কোথায় যাব, সেটাও জানা নাই।’
মিরপুরের বাসিন্দা দিদার একই কথা বললেন, ‘আগে প্রতি সপ্তাহে মশার ওষুধ ছিটানো হতো। কিন্তু এখন নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে না।’
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পালিয়ে যান সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা। পরে অন্তর্বর্তী সরকার মেয়র ও কাউন্সিলরের স্থলাভিষিক্ত করে আমলাদের। তবে ছয় মাসেও শৃঙ্খলা ফেরেনি নগর ভবনে। আগে মেয়র ও কাউন্সিলররা নগরীর মশক নিধন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম দেখভাল করতেন। এখন প্রশাসক ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের ঘাড়ে এই মহাকর্মের ভারে এ কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির। জনপ্রতিনিধি না থাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রমে মাঠে নেই মশক কর্মীরাও।
এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত চার মাসে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে। জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে তিন শতাধিক প্রাপ্তবয়স্ক মশা ফাঁদে ধরা পড়েছে, যা অক্টোবর ও নভেম্বরে ছিল দুইশর কম। মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উত্তরা, দক্ষিণখান ও মিরপুর এলাকায়।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত তা বেড়ে চরমে পৌঁছাবে। তারা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে গত বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে দুই সিটিতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেয়। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে মশা জন্মানোর হারও বেড়েছে। তাই অতি জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে মার্চ মাসেই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে শুরু করবে।
গত জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মশা গবেষণার জন্য রাখা ফাঁদে ধরা পড়ছে। রাজধানীর চার এলাকার পাঁচ স্থানের মধ্যে উত্তরায় মশা সবচেয়ে বেশি।
সেখানে জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ মশা ফাঁদে ধরা পড়েছে। ডিসেম্বরে একই ফাঁদে মশার সংখ্যা ছিল ৩০০। ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষক। উত্তরার পর সবচেয়ে বেশি দক্ষিণখানে ৪১০টি এবং মিরপুরে ৩৫০টি প্রাপ্তবয়স্ক মশা ধরা পড়ছে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার সমকালকে বলেন, মার্চে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব অনেক বেশি হবে। এ ছাড়া তাপমাত্রা বাড়লে মশা জন্মানোর হারও বাড়বে। তিনি বলেন, অনেক দিন ধরে বৃষ্টিপাত না থাকায় মশা জন্মানোর স্থান যেমন ড্রেন, ডোবা, নালা-নর্দমায় জৈব উপাদান বেড়ে যায়। এগুলো মশার লার্ভার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে বংশবিস্তার বেড়ে যায়। তাই অতি জরুরি ভিত্তিতে মশা জন্মানোর স্থানগুলো পরিষ্কার করে লার্ভা মারার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
নগরবাসীর অভিযোগ, আগে সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটালেও এখন এক মাসেও তাদের দেখা যায় না। তবে দুই সিটি করপোরেশন দাবি করছে, তারা প্রতিদিন মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে। কিন্তু যে হারে মশার উপদ্রব বাড়ছে, তা নিধনে সিটি করপোরেশনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, চলতি অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন, পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। এ টাকা দিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ভাষ্য একই রকম। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
নগরীতে পাঁচ শতাধিক খাল-ডোবা রয়েছে। এসব নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। আবার যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশকে নোংরা করে রাখা হয়। এসব থেকেও জন্ম নেয় নতুন মশা। মিরপুরের রূপনগর খাল, বাইশটেকি, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি খাল ও জলাশয় ঘুরে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিক, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ফেলে খালগুলো ভরে ফেলা হয়েছে।
রূপনগর খালে পড়েছে আশপাশের এলাকার কয়েকটি ড্রেন। এসব ড্রেনও ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ। তাতে জন্ম নিয়েছে লার্ভা। মেথর প্যাসেজ এলাকা ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। সেখানেও জন্ম নিচ্ছে মশা। মশক কর্মীরা সেখানে লার্ভিসাইডিং করলেও তাদেরই ঘিরে ধরে মশা। আবার এক দিন পরিষ্কার করে গেলে পরদিন একই অবস্থা।
উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন মশক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা বাসাবাড়ির আশপাশে ফগিং আর সকালে মশা যেখানে জন্মায়, সেখানে লার্ভিসাইডিং করি। কিন্তু এক ভবন থেকে আরেক ভবনের মাঝখানে যে মেথর প্যাসেজের গলি থাকে, সেখানে প্রবেশ করা যায় না। সেখানে ময়লা ফেলে স্তূপ করে রাখা হয়। তাতে মশার ওষুধ দিলেও কাজ হয় না। আবার খোলা ড্রেনে ওষুধ দিলেও কিন্তু বক্স কালভার্টে দেওয়ার উপায় নেই। সেখানে ড্রেনের পিট খুললে হাজার হাজার মশা বের হয়। সেখানে এত পরিমাণ ময়লা ফেলা হয়, প্রবেশ করাই যায় না।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী সমকালকে বলেন, মশা নিধনে আমরা নিয়মিত ক্রাশ প্রোগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করছি। কিন্তু তা তেমন কাজে আসছে না।
তিনি বলেন, ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল-ঝিল-খালে পানির প্রবাহ নেই। এসব স্থানে দীর্ঘদিন মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। এখানে লার্ভিসাইডিং ও ফগিং কোনো কাজে আসে না। একদিকে খাল-নর্দমা পরিষ্কার করলে আরেক দিকে ভরে যায়। এ ক্ষেত্রে নগরবাসীর সচেতনতা ছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. নিশাত পারভীন বলেন, কিউলেক্স মশা আগের চেয়ে বেড়েছে, এটা ঠিক। তবে মশা যাতে কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি।