যে দেশে দেড় দশকের দমন-পীড়নের পর নতুন সময় আসে, সেখানে একজন লেখকের ভূমিকা কেমন হবে এটা অনেক বড় প্রশ্ন। অন্যদিকে স্বাধীনতা খর্ব হলে সত্য বলা, বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর হওয়া এবং দেশের পক্ষে দাঁড়ানো কি কেবলই লেখকদের কর্তব্য?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অদম্য সাহস, দৃঢ়তা ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে সেই সময়ের আলোকচিত্র, ভিডিও ও সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে ৭ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে '৩৬ জুলাই: নির্ভীকদের অভিবাদন' প্রদর্শনীতে 'অভ্যুত্থান পরবর্তী লেখকের দায়' শীর্ষক আলোচনায় কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা এই প্রশ্ন তোলেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ ওয়াকিল আহমেদ। আলোচনা করেন, গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী, কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল, আফসানা বেগম, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, কবি মনিরুল মনির ও কথাসাহিত্যিক সাব্বির জাদিদ।
সাব্বির জাদিদ বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের অনেক কথা বলতে পারিনি। গল্প লিখেছি র্যাবের ক্রসফায়ার নিয়ে, সে গল্প নিয়ে বই প্রকাশ করতে পারিনি। এমন কঠিন সময় পার করেছি। আমরা লেখার স্বাধীনতা চাই।
কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, লেখক কার থেকে স্বাধীনতা চাইবে? বাঁক স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। এটা খর্ব হলেই কথা হবে, হবে প্রতিবাদ। কিন্তু আওয়ামীলীগ যে উন্নয়নের গল্পগুলো দিয়েছে তা মিথ্যা ছিল, আমরা চ্যালেঞ্জ করিনি। সবাই যে সুবিধার জন্য করেনি, তা না। কেউ কেউ সরকারের আদর্শকে নিজের আদর্শ মনে করত। লেখক হিসেবে আমাদের কর্তব্যবোধ ছিল জনগণের কণ্ঠস্বর জাগ্রত করা। আমরা তা করিনি, আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম। শাসনের এজেন্ডার নীরব সহযোগী হয়ে উঠেছিল কেউ কেউ। আমরা আমাদের নীরবতার দ্বারা জড়িত ছিলাম। এটা অপ্রত্যাশিত। তার বিপরীত কাজ এখন করতে হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যে আসুক, সে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে হবে।
নীরবতার মাধ্যমে জটিলতা সৃষ্টি নিয়ে একমত পোষণ করেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম। তিনি বলেন, লেখকরা সমাজের আয়না। আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সত্য লিখতে, বাস্তব সময়ে যা ঘটছে তা রেকর্ড করার জন্য এবং বিতর্ক, আলোচনা এবং বোঝার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে দায়বদ্ধ। সব সময়- লেখকদের ভূমিকা স্পষ্ট রাখা উচিৎ। লেখকরা জনগণের কণ্ঠস্বর এবং সেই কণ্ঠকে কখনই দমিয়ে রাখা উচিত নয়।
মনিরুল মনির বলেন, লেখক হিসেবে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি? ফ্যাসিবাদী শাসনামলে যখন প্রতিবাদ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তখন কি সত্যি করেছিলাম? ফলে আজকের দিনেও সমাজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কি কোনো পরিকল্পনা আছে লেখকদের?
এমন প্রশ্ন উদ্বেগজনক বাস্তবতাকে উন্মোচিত করে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এখনো বিভাজন, যারা অনেকেই সবচেয়ে সংকটময় মুহুর্তেও নীরব ছিল।
গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী বলেন, আজকের দিনের জন্য জুলাই বিদ্রোহের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা। ছোট ছোট বাচ্চারা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। ছাত্ররা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমরা লেখক হিসেবে কী করেছি? তাদের জন্য লিখতে পারছি কি? দিনের পর দিন আমরা নিরব থেকেছি। এর চেয়ে সামনের সারিতে মরে যাওয়া ভালো।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সাম্যের জন্য, মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য, প্রতিটা মানুষের ন্যায় বিচার রক্ষার জন্য। জুলাই আন্দোলনের পর বাংলাদেশ নির্মাণ হবে সাম্য,মানবিক মর্যাদা, ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সাঈদ ফেরদৌস তার আলোচনায় ফরায়েজীর আহ্বানের সঙ্গে যোগ করে বলেন, আগামী দিনে বুদ্ধিজীবীরা কঠোর আত্ম-পরীক্ষায় থাকবেন। কারণ দৃশ্যমান শত্রুদের বিরুদ্ধে লেখা সহজ, ভণ্ডামি বা অদৃশ্য শত্রুদের মোকাবিলা করা কঠিন। তাই আপসহীনভাবে বলে ও লিখে যেতে হবে।
কথাসাহিত্যিক আহমদ মোস্তফা কামাল বলেন, শিরোনামে লেখকের দায় না হয় হতে পারে অভ্যুত্থান পরবর্তী লেখকের দায়িত্ব। তাহলে আলাপটা পরিস্কার হয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনা সরকার পালানোর পর ৩ দিনেরও বেশি সময় ধরে দেশটি আনুষ্ঠানিক আইনশৃঙ্খলা ছাড়াই ছিল। সেভাবে কোনও বিশৃঙ্খলা হয়নি। জনগণ একে অপরকে রক্ষা করেছে। এটি দেখায় যে আমরা নাগরিক হিসেবে আমাদের জাতিকে রক্ষা করতে সক্ষম। আমাদের আর কখনোই এখানে ফ্যাসিবাদকে শিকড় গাড়তে দেওয়া হবে না।
এর মাঝে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩টি কাজ জরুরি। বাজার সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়া, আইন শৃঙ্খলা ঠিক করা, ক্রিমিনালদের যথাযথ মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো লুকোচুরি জনগণ মানবন না। এগুলো করে নির্বাচনের দিকে আগান।
শিক্ষাবিদ ওয়াকিল আহমেদ গণঅভ্যুত্থানে লেখকদের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে আলোচনা শেষ করেন। তিনি বলেন, অনেক দিন বাসা থেকে বের হই না, কেউ ডাকেওনি ১৫ বছর। তাই প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগহীন। অনেক কম জানি। যতটা জেনেছি পত্রিকার মাধ্যমে। এর মাঝে আমাদের দেশের প্রজন্ম কতটা এগিয়েছে তা অভাবনীয়। জুলাই বিপ্লবের সাফল্য আমরা ভবিষ্যতের জন্য লিখে যাব।
শুরতে ডেইলি স্টারের সাংবাদিকরা, বিশেষত আলোকচিত্রীরা জীবনঝুঁকি নিয়ে সেই দিনগুলোতে পেশাগত কর্তব্যপালন করেছেন সে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র 'দ্রোহের জুলাই: সংবাদে, সংগ্রামে' তথ্যচিত্রও দেখানো হয়। অনুষ্ঠান শেষে সবাই প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইমরান মাহফুজ। দ্যা ডেইলি স্টার