আর কোনও কৌশলগত অস্পষ্টতা নয়, আর কোনও নরম ভাষা নয়। পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপির লড়াই যে এবার সরাসরি ক্ষমতা দখলের, তা স্পষ্ট করে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বুধবার কলকাতায় দলীয় বৈঠক ও কর্মী সম্মেলন থেকে তার ঘোষণা, দিল পে লিখ লো, হামারি সরকার হোগা (মনে লিখে রাখুন, আমাদের সরকার হবে)। লক্ষ্য একটাই, ২০০ আসন।
কলকাতার সল্টলেক ও সায়েন্স সিটিতে একের পর এক বৈঠকে বিজেপির নেতা, বিধায়ক, সাংসদ ও কর্মীদের উদ্দেশে শাহ কার্যত নির্বাচনি রোডম্যাপ বেঁধে দেন। তার বার্তায় স্পষ্ট, ২০২৬-এর লড়াই আর শুধু তৃণমূল সরকারবিরোধী নয়, এটি বিজেপির অস্তিত্বের লড়াই। সেই লড়াইয়ের মূল অস্ত্র হবে অনুপ্রবেশ, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ও রাজ্যের নিরাপত্তা। পাশাপাশি দুর্নীতি ও ব্যর্থ শাসন-এর অভিযোগও সামনে রাখা হবে।
বুধবার সকালে সল্টলেকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে অমিত শাহ বলেন, আমরা যদি তিন আসন থেকে ৭৭ আসনে পৌঁছাতে পারি, তাহলে ৭৭ থেকে ২০০ কেন পারব না? তার দাবি, কলকাতা আর নিরাপদ নেই। অনুপ্রবেশ বাড়লে বিপদ আরও ঘনীভূত হবে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে গোড়া থেকে সরকার উপড়ে ফেলতে হবে, এমন মন্তব্যও করেন তিনি।
একই সঙ্গে জোর দেন সংগঠনের শক্তি বাড়ানোর ওপর। কর্মীদের উদ্দেশে তার নির্দেশ, একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে, সবাইকে জাগ্রত করতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের সমস্যা, দুঃখ-দুর্দশা শুনতে হবে। শাহ বলেন, তৃণমূল সরকার মা-মাটি-মানুষ-এর কথা বললেও বাস্তবে মা বিপন্ন, মাটিতে অনুপ্রবেশের দাপট।
বিজেপি সূত্রে জানা গেছে, দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকায় আরও বেশি সময় দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শাহ। শুধু নিজের এলাকা নয়, পাশের এলাকাতেও সংগঠন মজবুত করে জেতানোর বার্তা দিয়েছেন তিনি। বিধায়কদের জন্য দিনে পাঁচ থেকে ছয়টি সভা করার লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সাংসদদের ক্ষেত্রেও মাঠে নামার নির্দেশ থাকলেও সভার সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়নি।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় মাইক ব্যবহার বন্ধ থাকলেও প্রচার বন্ধ থাকবে না, এই বার্তাও দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই সময় কর্মীদের বাড়িতে যেতে, তাদের সঙ্গে চা খেতে, অভিযোগ ও ক্ষোভ শুনতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুরোনো কর্মীদের অসন্তোষ প্রশমনে বিশেষ জোর দিতে বলা হয়েছে জেলা নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬-এর ভোটে দুটি বিষয়কে সামনে রেখে প্রচার চালাতে বলেছেন অমিত শাহ। এক, সীমান্ত অনুপ্রবেশ; দুই, অনুপ্রবেশকারী মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্ন। এই ইস্যুতে আর রক্ষণাত্মক নয়, আক্রমণাত্মক অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিধায়কদের সপ্তাহে অন্তত চার দিন নিজ এলাকায় থাকতে হবে, অন্তত পাঁচটি পথসভা করতে হবে। আগামী দুই মাসে কাজের মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারলে পুনরায় টিকিট পাওয়া কঠিন, এই বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
বুথ সংগঠনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ এসেছে কোর কমিটির বৈঠক থেকে। আগে বুথ শক্তিশালী করা, তারপর জয়—এই সূত্রেই এগোতে চায় বিজেপি। সাবেক সাংসদদের তাদের পুরোনো লোকসভা কেন্দ্রে সক্রিয় হতে বলা হয়েছে। জয়ী-পরাজিত নির্বিশেষে সব বিধায়ক ও সাংসদকে পথে নামার নির্দেশ দিয়েছেন শাহ।
দুপুরে সায়েন্স সিটিতে কলকাতা জোনের কর্মী সম্মেলনে চার সাংগঠনিক জেলার ২৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২০টি জয়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেন অমিত শাহ। কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ, কলকাতা উত্তর শহরতলি ও যাদবপুর—এই চার এলাকার নেতা-কর্মীরা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
মঞ্চ থেকে শাহ বলেন, বিজেপি থামার নয়। তৃণমূল সরকারকে নিশানা করে তার মন্তব্য, এই রাজ্যে দুটো জিনিস ভয়ঙ্কর। একটা অনুপ্রবেশ, আরেকটা দুর্নীতি। কলকাতার নিরাপত্তা নিয়ে ফের উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনুপ্রবেশ বাড়লে সাধারণ মানুষই বিপদে পড়বেন।
সম্মেলনের শেষে অমিত শাহ স্পষ্ট করে দেন, কোনও সমঝোতার রাজনীতি নয়। যেই প্রার্থী হোক, তাকে জেতাতেই হবে। তার কথায়, লিখে নিন, এবার পশ্চিমবঙ্গে আমাদেরই সরকার হবে।
কলকাতা ছাড়ার আগে বিজেপির নেতা-কর্মীদের জন্য অমিত শাহর বার্তার সারকথা একটাই, আগে বুথ, তারপর সরকার। অনুপ্রবেশ বনাম সরকার, এই দ্বন্দ্বেই নির্ধারিত হবে বাংলার ক্ষমতার ভবিষ্যৎ।