Image description
 

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টরদের (এফওআই) অনেকের বৈধ লাইসেন্স নেই। লাইসেন্সবিহীন ও নন-কারেন্ট (নিয়মিত উড্ডয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন) এসব পরিদর্শকের মাধ্যমেই পাইলটদের লাইসেন্স নবায়ন, চেক রাইড ও সার্টিফিকেশন সম্পন্ন হচ্ছে। এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দেশের বিমান চলাচল ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) নির্দেশনায় এফওআই কর্মকর্তাদের লাইসেন্স থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা তোয়াক্কা করছে না বেবিচক। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশন প্রোসিডিউরের শর্তও লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

তবে বেবিচক দাবি করছে, পরিদর্শকদের কাজ পাইলটদের লাইসেন্স দেওয়া বিষয়টি ঠিক এমন নয়। সিমুলেটর টেস্টের মাধ্যমে পাইলটরা লাইসেন্স পান। পরিদর্শকরা প্রক্রিয়াটি কেবল যাচাই করে থাকেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেবিচকের বেশির ভাগ কর্মকর্তারই দীর্ঘদিন ধরে এয়ারলাইন ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স (এটিপিএল) নেই। তাঁদের মধ্যে একজন কর্মকর্তার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৯ বছর আগে। বেবিচকের এফওআইদের লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকার মতো গুরুতর অনিয়মগুলো আইকাওয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে। ফলে আগামী আইকাও ‘কো-অর্ডিনেটেড ভেলিডেশন মিশন’ অডিটে বাংলাদেশ ‘সিগনিফিক্যান্ট সেফটি কনসার্ন (এসএসসি)’-এর মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো প্লেন কেনা, ভাড়া, কোড-শেয়ার এবং রুট সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

এ বিষয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক আমাদের সময়কে বলেন, এফওআইদের মেয়াদ থাকা না থাকার বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন সংস্থার মেম্বার (এফএসআর)। পরে এ বিষয়ে কথা হয় সদস্য (ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশনস) এয়ার কমোডর মুকিত উল আলম মিয়ার সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, পাইলটদের লাইসেন্স দেওয়ার অনুমাদন প্রক্রিয়াটি ঠিক এমন নয়। তবে পরিদর্শকরা তা যাচাইকাজ করে থাকেন। এদের লাইসেন্সের মেয়াদ থাকা বাধ্যতামূলক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

বেবিচকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বয়স্ক এসব ইন্সপেক্টরের পরিবর্তে লাইসেন্সধারী দক্ষ ইন্সপেক্টর নিতে না পারার কারণও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বেতনসহ আনুষঙ্গিক সুবিধার ঘাটতি। বেবিচক চাইলেই চাহিদানুয়ায়ী সব সুবিধা দিতে পারছে না। তবে এতে কোনোভাবেই আইকাওয়ের বিধান লঙ্ঘন হচ্ছে না।

সূত্র মতে, আইকাওয়ের ডক ৮৩৩৫ এর ৬.২.১.১ নম্বর অধ্যায় অনুযায়ী, লাইসেন্স-সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনকারী যে কোনো ইন্সপেক্টরকে বৈধ পাইলট লাইসেন্স ও বর্তমান টাইপ রেটিংসহ পূর্ণ অপারেশনাল যোগ্যতা থাকতে হবে। বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশন প্রোসিডিউরেও একই শর্ত রয়েছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন এফওআই পাইলটের শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফ্লাইট ঘণ্টা, টাইপ রেটিং, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, লিখিত পরীক্ষা, সিমুলেটর পরীক্ষা বা লাইভ ফ্লাইট পরীক্ষা তদারকি করেন। তাঁরা নিশ্চিত করেন যে, পাইলট নিরাপদভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করতে সক্ষম কি না। পাইলটের প্রশিক্ষণ, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, পূর্বের লাইসেন্স রেকর্ডে কোনো অনিয়ম বা তথ্যের ঘাটতি আছে কি না। তবে যেসব কর্মকর্তা এই পদে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের নিজের কারোই লাইসেন্স নেই। সেক্ষেত্রে যোগ্যতা ছাড়াই তাঁরা লাইসেন্স প্রদানের কাজ করছেন। অনিয়মের অভিযোগের মধ্যেই চলতি বছরের ৮ নভেম্বর এফওআই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বেবিচক। তাদের এই বিজ্ঞপ্তিতেও আবেদনকারীর যোগ্যতার জন্য আইকাও যে মানদণ্ড দিয়েছে, তার কোনোটিই মানা হয়নি।

বাংলাদেশে বর্তমানে এফওআই হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনেরই লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। তাঁরা হচ্ছেন ক্যাপ্টেন রাফি উল হক, ক্যাপ্টেন ফরিদ উজ জামান, ক্যাপ্টেন আশরাফুল আজহার, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ মিয়া এবং ক্যাপ্টেন মনিরুল হক জোয়ারদার। অপরজন ক্যাপ্টেন ফেরদৌস হোসেনের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে ৬৮ বছর বয়সে। তাঁর এয়ার ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স (এটিপিএল) নম্বর ৪১২। আইকাওয়ের বাধ্যবাধকতা থাকলেও মেডিক্যাল সংক্রান্ত তাঁর কোনো কোনো ডকুমেন্ট চায়নি বেবিচক।

বেবিচক সূত্র জানায়, ক্যাপ্টেন রাফি উল হকের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০০৬ সালে (এটিপিএল নম্বর ২৬), ক্যাপ্টেন ফরিদ উজ জামানের ২০১৫ সালে (এটিপিএল নম্বর ৬৫), ক্যাপ্টেন আশরাফুল আজহারের ২০১৬ সালে (এটিপিএল নম্বর ১৫২), ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ মিয়া ২০১৫ সালে (এটিপিএল নম্বর ৮০) এবং ক্যাপ্টেন মনিরুল হক জোয়ারদারের ২০২৫ সালের জুলাই মাসে (এটিপিএল নম্বর ১৪৩)। প্রশ্নবিদ্ধ এফওআই কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম ক্যাপ্টেন ফরিদ উজ জামান। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স এবং ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে চাকরি করেছেন।

ক্যাপ্টেন আশরাফুল আজহার বিমান বাহিনীর ট্রান্সপোর্ট পাইলট ছিলেন। এফওআই হওয়ার জন্য একজন ক্যাপ্টেনের ৫ হাজার ঘণ্টা ফ্লাইং আওয়ারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে বেবিচকের। ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ মিয়া বিমান বাহিনীতে বিমান প্রশিক্ষণের পর প্ল্যান্ট প্রোটেকশন উইংয়ে চলে যান। এরপর তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চিফ অব টেকনিক্যাল এবং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তবে তাঁর অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ক্যাপ্টেন ফেরদৌস হোসেন বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন। তাঁর কমার্শিয়াল ফ্লাইট পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ক্যাপ্টেন মনিরুল হক জোয়ারদার বিমান বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর এয়ার পারাবতের চিফ ফ্লাইং ইন্সট্রাকটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।