দশমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার সময় নীতীশ কুমারের কণ্ঠে ও আচরণে বয়সের ছাপ স্পষ্ট ছিল। তবুও বিহারের রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব এতটাই দৃঢ় যে বিজেপি আবারও তাঁকেই রাজ্যের দায়িত্বে বসিয়েছে। সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজেপি সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও জোট রাজনীতির স্বার্থে তাদের ভরসা রাখতে হয়েছে নীতীশের ওপর।
নীতীশ কুমার বিহারের ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রায় দুই দশক ধরে। ২০০৫ সাল থেকে যে জোটে তিনি থেকেছেন, সেটিই ক্ষমতায় এসেছে। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক গ্রহণযোগ্যতা এবং বিহারের জাতপাত নির্ভর রাজনৈতিক কাঠামোতে এক বিরল ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতাই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দাঁড় করিয়েছে।
বিহারের রাজনীতিতে বিজেপি ও বামপন্থীরা ক্যাডার-ভিত্তিক দল হলেও আরজেডি বরাবরই নির্ভর করেছে তাদের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম-ইয়াদব ভোটব্যাংকের ওপর। এই দুই শক্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নীতীশ কুমার গড়ে তুলেছেন বিস্তৃত সামাজিক সমীকরণ, যেখানে কুর্মি-কৈরি গোষ্ঠীর পাশাপাশি অতি পশ্চাৎপদ জাতি, মহাদলিত এবং নারী ভোটাররা যুক্ত হয়েছেন। এই ভোটব্যাংক তাকে বারবার টিকিয়ে রেখেছে ক্ষমতায়। বিশেষ করে নারীদের জন্য সাইকেল, ইউনিফর্ম, স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও আর্থিক সহায়তার প্রকল্প তাঁর প্রতি নারী ভোটারদের আস্থা আরও গভীর করেছে। দুই প্রজন্ম ধরে এই সমর্থন গড়ে ওঠায় তিনি রাজনৈতিকভাবে আরও নির্দলীয় হয়ে ওঠেন।
রাজ্যের সামাজিক কাঠামোতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছেন। জাতিগত জনগণনা সম্পন্ন করে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জনসংখ্যার সুনির্দিষ্ট হিসাব সামনে আনা—বিজেপির আপত্তির মধ্যেও—নীতি নির্ধারণে নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। এই বাস্তবতায় জোটের অভ্যন্তরে নীতীশের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের ঠিক পরেই তাঁকে সরানোর মতো ঝুঁকি নিতে চাইবে না বিজেপি, কারণ সামনে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে নির্বাচন আছে এবং নেতৃত্ব বদলের বার্তা অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
তবে সমালোচনার জায়গাও কম নয়। মানব উন্নয়ন সূচকে শিক্ষায়, কর্মসংস্থানে ও মাথাপিছু আয়—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিহার পিছিয়ে আছে। তা সত্ত্বেও ২০২৫ সালের নির্বাচনে তেমন কোনও বড় অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি তরঙ্গ দেখা যায়নি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, উন্নয়ন সূচকে দুর্বলতা সত্ত্বেও সামাজিক প্রকল্পভিত্তিক সুবিধাগুলো ভোটের হিসাব বদলে দেয়। এবারও লক্ষাধিক নারীর অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের ঘটনাকে অনেকেই সেই প্রভাবের উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।
সব মিলিয়ে, বয়স বাড়ছে, শারীরিক সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট—তবুও বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমারের বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি। বিজেপির কাছেও তিনি জোটের সবচেয়ে কার্যকর, গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয় মুখ। তাই নানা জটিলতা সত্ত্বেও নীতীশ কুমারই হয়ে উঠেছেন এনডিএ-র অনিবার্য নেতা, এবং বিহারের রাজনীতি তাঁকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা