গত কয়েক মাসে অন্তত ২৪ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় যে কফ সিরাপে বিষাক্ততা পাওয়া গেছে, সেটির উপাদান সরবরাহে কোনো গাফিলতি হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখছে ভারতের কর্মকর্তারা। খবর রয়টার্সের।
তামিলনাড়ুর তিনজন স্বাস্থ্য ও ওষুধ নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা সন্দেহ করছেন ‘কোল্ডরিফ’ নামের সিরাপ তৈরিতে ব্যবহৃত সলভেন্টটি বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে দূষিত হতে পারে। এই সলভেন্ট সরবরাহ করা হয়েছিল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান শ্রেসান ফার্মাসিউটিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারারকে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ শ্রেসান ৫০ কেজি প্রোপাইলিন গ্লাইকোল (পিজি) কিনেছিল স্থানীয় একটি রাসায়নিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘সানরাইজ বায়োটেক’ থেকে। আর সানরাইজ ওইদিনই এটি কিনেছিল চেন্নাইভিত্তিক ছোট একটি কোম্পানি ‘জিনকুশল অ্যারোমা’ থেকে, যারা মূলত তরল ডিটারজেন্টে ব্যবহারের জন্য সুগন্ধি তৈরি করে।
তামিলনাড়ুর ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ৩ অক্টোবর একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানেই এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে তারা এ বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘কোল্ডরিফ’ সিরাপে যে রাসায়নিক পাওয়া গেছে, তা হলো ডায়েথিলিন গ্লাইকোল (ডিইজি)—এটি একটি শিল্পে ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিক। সাধারণত ওষুধে দ্রাবক হিসেবে ব্যবহৃত পিজির পরিবর্তে ভুলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই ঘটনাগুলো আবারও ভারতের ওষুধ শিল্পে নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় ভারতের তৈরি দূষিত কফ সিরাপে অন্তত ১৪০ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
সেসময় ভারত সরকার মান নিয়ন্ত্রণ জোরদারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেন, ডিইজি কখনও কখনও পিজির চেয়ে সস্তা হওয়ায় প্রতারণামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক কিডনি বিকলতা ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
এই তদন্তে প্রথমবারের মতো উঠে এসেছে কীভাবে স্রেসানে রাসায়নিক পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানের গাফিলতি হয়েছিল।
এই ঘটনায় শ্রেসানের উৎপাদন লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে এবং এর প্রতিষ্ঠাতা জি. রঙ্গনাথন বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। তার অফিস বা বাসভবনের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার পক্ষে কোনো আইনজীবীর নামও পাওয়া যায়নি।
ভারতের কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন’ এই বিষয়ে মন্তব্য না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে নির্দেশ দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তারা শিশুদের ব্যবহারের ওষুধগুলো পর্যালোচনা করছে এবং বিভিন্ন ওষুধ কারখানায় পরিদর্শন বাড়িয়েছে।
সাধারণত পিজি জাতীয় দ্রাবকগুলো সিল করা পাত্রে সরবরাহ করা হয়, যাতে দূষণ রোধ করা যায়। কিন্তু সানরাইজ জানিয়েছে, তারা এই দ্রাবক খোলাভাবে পুনঃপ্যাকেট করে শ্রেসানকে সরবরাহ করে।
ভারতের ওষুধ ও কসমেটিকস আইন অনুযায়ী, যাদের ড্রাগ লাইসেন্স নেই, তারা ওষুধ তৈরির উপযোগী উপাদান ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে না।
জিনকুশল ও সানরাইজ—এই দুই প্রতিষ্ঠানের কারোরই এমন লাইসেন্স নেই। তাদের মালিকরা রয়টার্সকে বলেন, তারা জানতেন না যে এই দ্রাবক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হবে।
দুজনই দাবি করেছেন, তারা কোনোভাবেই ডিইজি রাখেন না বা এর উপস্থিতির ব্যাপারে জানতেন না।
তদন্তে এখনও স্পষ্ট হয়নি কীভাবে দ্রাবকটি দূষিত হয়েছিল বা কার দায়ে।
তদন্তে আরও দেখা গেছে, চেন্নাইয়ের বাইরের শ্রেসান কারখানায় ‘অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে’ ওষুধ রাখা হতো, এবং ‘তথ্য জালিয়াতি’র মতো শত শত বড় ধরনের অনিয়ম ছিল। তবে এই গাফিলতিগুলোর সঙ্গে শিশুদের মৃত্যুর সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
শ্রেসান দাবি করে, তারা যে পিজি ব্যবহার করেছে তা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘এসকে পিকগ্লোবাল’-এর তৈরি। সরবরাহকারীরা যে বিশ্লেষণ সনদ দিয়েছে, তাতে ওই তথ্য রয়েছে। তবে রয়টার্স এই সনদের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। এসকে পিকগ্লোবাল অবশ্য জানিয়েছে, সনদটির অনুলিপি আসল বলেই মনে হচ্ছে।
এই দ্রাবক ২১৫ কেজি ওজনের সিল করা ব্যারেলে পাঠানো হয়েছিল। জিনকুশল সেটির সিল ভেঙে দোকানে পুনঃপ্যাক করে কিছু অংশ সানরাইজকে বিক্রি করে। সানরাইজ পরে সেগুলো খোলা পাত্রে শ্রেসানে পাঠায়।
এসকে পিকগ্লোবাল জানায়, তাদের পণ্যে পুনঃপ্যাক বা পুনঃবিক্রয় কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তারা ক্রেতাদের আগেই সতর্ক করেছে যে, পুনঃপ্যাক পণ্যের গুণমানের নিশ্চয়তা তারা দেয় না।
শ্রেসান অতীতেও অনিয়মে জড়িত ছিল। ২০২০ ও ২০২২ সালে এর প্রতিষ্ঠাতা এক দিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, পরে জরিমানা করা হয়। যদিও এই ঘটনার প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি।
তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত মাসে জানান, ২০২১ ও ২০২৩ সালে শ্রেসান ‘ছোটখাটো কিছু অনিয়মে’ জরিমানার মুখে পড়ে।
যদিও নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর পরিদর্শন হওয়ার কথা, শ্রেসানের কারখানা ২০২৩ সালের পর আর পরিদর্শিত হয়নি বলে জানিয়েছেন দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
রয়টার্স স্বাধীনভাবে জানতে পারেনি, শেষ কবে শ্রেসানের কারখানা পরিদর্শিত হয়েছিল।