Image description
 

রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের উপকূলে ৩০ জুলাই ভোরে আঘাত হানে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি গভীর সমুদ্রের নিচে হওয়ায় দ্রুতই আশপাশের দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়- বিশেষ করে জাপান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে শুধু কম্পনের ভয় নয়, সবার বড় আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘সুনামি’। কিন্তু আসলে কেন সুনামি হয়? কেন এর ঢেউ এত ভয়ানক রকম প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে?

সাধারণ ঢেউ নয়, গভীর থেকে উঠে আসা জলপ্রাচীর

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণ সমুদ্রের ঢেউ মূলত বাতাসের প্রভাবে পানির উপরিভাগে সৃষ্টি হয়। কিন্তু সুনামির তরঙ্গ জন্ম নেয় গভীর সমুদ্রের তলদেশে, যেখানে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বা ভূমিধস হঠাৎ করে বিশাল জলরাশি একসঙ্গে সরিয়ে দেয়। এই পানির স্তম্ভ যখন সরতে শুরু করে, তখন তার শক্তি হয়ে ওঠে ধ্বংসাত্মক। অনেক সময় ঢেউয়ের উচ্চতা মাত্র কয়েক মিটার হলেও এর গতি, চাপ ও বিস্তৃতির কারণে তা নিমিষেই উপকূলীয় এলাকা গিলে নিতে পারে।

 

কীভাবে জন্ম নেয় সুনামি?

 
 

পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে রয়েছে বিশাল বিশাল টেকটোনিক প্লেট। যখন একটি প্লেট আরেকটির নিচে ঢুকে যায়, তখন সেখানে প্রচুর শক্তি জমা হতে থাকে। এই সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ একসময় মুক্ত হয়ে গেলে সমুদ্রের তলদেশে ঘটে যায় বিশাল রকমের সঞ্চালন। তখন সাগরের পানির বিরাট অংশ এক ধাক্কায় সরে যায় ওপর কিংবা নিচের দিকে। এর ফলেই সুনামির সূচনা।

 

গভীর সমুদ্রে সুনামির ঢেউ ঘণ্টায় ৭০০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলে, যা একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের গতির সমান। কিন্তু তখন এই ঢেউয়ের উচ্চতা হয়তো মাত্র ১-২ মিটার। তাই জাহাজে থাকা মানুষজন বুঝতেই পারেন না, তারা ভয়ংকর এক তরঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু উপকূলে পৌঁছানোর সময়ই ঘটে সর্বনাশ। সমুদ্রের তলদেশ ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকায় ঢেউয়ের গতি কমে যায়, কিন্তু পেছন থেকে ধেয়ে আসা বিশাল জলরাশির চাপ কমে না। ফলে এই তরঙ্গ বিশালাকার জলপ্রাচীরে রূপ নেয়, যা দেয়ালের মতো উপকূলে উঠে এসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে জনপদ, গ্রাম ও নগর।

ইতিহাসের ভয়াবহতম সুনামিগুলো

২০০৪ সালের সুমাত্রা সুনামি : ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পের পর ইন্দোনেশিয়াসহ ভারত মহাসাগরীয় উপকূলে আঘাত হানে এক প্রলয়ংকরী সুনামি। এতে প্রাণ হারায় প্রায় ২৮০,০০০ মানুষ।

২০১১ সালের জাপান : ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ও এর পরবর্তী সুনামিতে মারা যান অন্তত ২০,০০০ মানুষ।

১৮৮৩ সালের ক্রাকাতোয়া : আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও সুনামিতে নিহত হন প্রায় ৩৬,০০০ জন।

১৭৫৫ সালের পর্তুগাল (লিসবন) ভূমিকম্প : সুনামিসহ কম্পনে প্রাণ হারান ৩০-৫০ হাজার মানুষ।

১৯৭৬ সালের ফিলিপাইন : মিনদানাও অঞ্চলে ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামিতে মৃত্যু হয় ৮ হাজার মানুষের।

সুনামির ঢেউ এত প্রাণঘাতী কেন?

জাপানি সুনামি বিশেষজ্ঞ কুবোতা তাতসুয়া বলেন, ‘সাধারণ ঢেউয়ের মতো সুনামির তরঙ্গ শুধু উপরিভাগে নয়, পুরো পানির স্তম্ভ একসঙ্গে এগিয়ে আসে। তাই এর ধাক্কা অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক।’ তিনি আরও বলেন, প্রথম ঢেউটি ছোট মনে হলেও বিপদ পেরোয় না। পরের ঢেউ অনেক বেশি শক্তিশালী ও উঁচু হতে পারে। সেজন্যই উপকূলে যারা থাকেন, তাদের সতর্কতা মেনে চলা এবং প্রথম সংকেতেই নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

আগাম সতর্কতা ও প্রতিরোধই একমাত্র পথ

বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ উপকূলীয় এলাকায় বাস করেন, যারা সুনামির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তাই আগাম সতর্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানীরা বুয়ি সেন্সর, স্যাটেলাইট, ভূকম্পন পরিমাপক ও কম্পিউটার মডেলিং ব্যবহার করে আগাম সুনামি সতর্কতা দিতে পারছেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার প্রস্তুতি না থাকলে সতর্কতা যথেষ্ট নয়।

বিশেষ করে ‘রিং অব ফায়ার’ অঞ্চলের জন্য, যেটি প্রশান্ত মহাসাগরের চারদিকে বিস্তৃত, যেখানে একাধিক সক্রিয় টেকটোনিক প্লেট রয়েছে- সে এলাকাগুলোতে সুনামির সম্ভাবনা সবসময় বেশি।