Image description

ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে রুশ সেনা ও তাদের সরঞ্জামকে নিশানা করে চালানো হচ্ছে ড্রোন হামলা। সেসব হামলার ভিডিও করা হচ্ছে, তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে, হিসাব রাখা হচ্ছে; যা ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধকৌশলে। কারণ, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী এখন তাদের চেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব কৌশলগত সুবিধা আদায় করতে চাইছে।

গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া প্রকল্প ‘আর্মি অব ড্রোনস: বোনাস’ (‘ই-পয়েন্টস’ নামেও পরিচিত)-এর আওতায় প্রতিটি ধ্বংস বা হত্যার জন্য ইউক্রেনীয় সেনাদের পয়েন্ট দেওয়া হচ্ছে।

 

জনপ্রিয় ভিডিও গেম কল অব ডিউটির কিলস্ট্রিকের মতো এই প্রকল্পেও পয়েন্ট মানেই পুরস্কার।

ইউক্রেন সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত ব্রেভ ওয়ান দল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, লক্ষ্যবস্তু যত বেশি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় মাপের হয়, প্রতিটি ইউনিট তত বেশি পয়েন্ট পায়। যেমন শত্রুপক্ষের রকেট লঞ্চার ধ্বংস করলে মেলে ৫০ পয়েন্ট ট্যাংক ধ্বংসে ৪০ পয়েন্ট আর ট্যাংক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করলে পাওয়া যায় ২০ পয়েন্ট।

এই পুরো প্রক্রিয়াকে অনেকে বলছেন ‘যুদ্ধের গেমিফিকেশন’ অর্থাৎ যুদ্ধকে গেমের কাঠামোতে রূপ দেওয়া।

বিবিসি বলছে, প্রতিটি ড্রোন ভিডিও সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয় রাজধানী কিয়েভে। সেখানে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ও কৌশলগত অগ্রাধিকার অনুযায়ী পয়েন্ট বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল।

এই ‘ই-পয়েন্টস’ প্রকল্পের নেপথ্যের কারিগর ইউক্রেনের ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনমন্ত্রী মিখাইলো ফেদোরভ।

মিখাইলো ফেদোরভ বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। এটি একধরনের যুদ্ধের গণিত, যেখানে সীমিত সম্পদ সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরের বিধ্বংসী যুদ্ধে এই প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে।

 

ফেদোরভ বলেন, এই প্রকল্পের ভিত্তিই অনুপ্রেরণা। আমরা যখন পয়েন্টের মান পরিবর্তন করি, তখন দেখি, যোদ্ধাদের উৎসাহও পরিবর্তিত হয়।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেদোরভের কার্যালয়ে রয়েছে বেশ বড় একটি স্ক্রিন, যেখানে ইউক্রেনীয় ড্রোন থেকে সম্মুখ সমরের ওপর নজর রাখা ডজনখানেক ভিডিও সরাসরি দেখা যায়।

এই লাইভ দৃশ্যপট থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইউক্রেনের ড্রোননির্ভর যুদ্ধ পরিস্থিতি। দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদের দাবি, বর্তমানে রুশ সেনা হতাহতের প্রায় ৭০ শতাংশই ড্রোন আক্রমণের ফল।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসনের শুরুর দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একের পর এক ড্রোন ভিডিও। সেসব ভিডিওর নেপথ্যে বাজতে থাকে হেভি মেটাল সংগীত আর সামনে যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহ দৃশ্য।

এসব ভিডিও মূলত সীমান্তের অপর প্রান্তে থাকা সেনার মৃত্যু উদ্যাপন করে বানানো হয়।

তবে কেবল কৌতূহল বা প্রতিশোধের তৃপ্তিই নয়, ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের সেনারা এখন জানেন, এই ভিডিও ফুটেজ তাদের জন্য পুরস্কারও বয়ে আনতে পারে।

এই সেনারা ‘ই-পয়েন্টস’ প্রকল্পটি কীভাবে দেখছেন, তা জানতে বিবিসি যোগাযোগ করে ইউক্রেনের এক ডজনের বেশি সামরিক ইউনিটের সঙ্গে। প্রতিক্রিয়াগুলো ছিল মিশ্র।

ইউক্রেনের ১০৮তম টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স ব্রিগেডের ভলোদিমির নামের এক সেনা বলেন, সাধারণভাবে আমি ও আমার সহযোদ্ধারা এই প্রকল্প নিয়ে ইতিবাচক। এটি আমাদের হারানো সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণের একটা উপায়। সেই সঙ্গে শত্রুপক্ষকে যতটা সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত করার কৌশল।

দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে লড়াইরত ২২তম মেকানাইজড ব্রিগেড প্রায় তিন মাস ধরে এই নতুন প্রকল্পের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার সময় পেয়েছে।

এই ব্রিগেডের সেনা জ্যাক বলেন, প্রকল্পের ধরন দেখে আমাদের মনে হয়েছে এটি বেশ ভালো একটি উদ্যোগ। যুদ্ধ করতে করতে আমাদের ছেলেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মন কোনো কিছুতেই টানে না। কিন্তু এই প্রকল্প কিছুটা হলেও তাদের সাহায্য করছে। তারা পুরস্কার পাচ্ছে। এটা একটা ভালো মোটিভেশন।

তবে এই প্রকল্প নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। অনেকের কাছে ‘ই-পয়েন্টস’ সেনাদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত প্রেরণা জোগাতে পারছে না।

স্নেক নামের এক সেনা বলেন, শুধু পয়েন্ট দিয়ে সেনাদের পালিয়ে যাওয়া ঠেকানো যাবে না।

আরেক সেনা দিমিত্রো বলেন, এই প্রকল্প আমাদের বিকৃত মানসিকতারই ফল, যেখানে আমরা প্রতিটা জিনিসকে মুনাফায় রূপান্তর করতে চাই, এমনকি নিজেদের মৃত্যুকেও।

সূত্র: বিবিসি