
বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংকের মতিঝিলের হাটখোলা শাখার ডজনখানেক গ্রাহকের অজান্তে তাদের নামে ঋণ সৃষ্টি করে পকেটস্থ করার অভিযোগ উঠেছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের হাতে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকাকালীন এ ঘটনা ঘটে। এর দায়ে ইতোমধ্যে শাখা ব্যবস্থাপককে বরখাস্ত করে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে তদন্ত শুরু করেছে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা গত বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত শাখার কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। এরপরই বিষয়টি জানাজানি হয়। ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, ব্যাংকটির হাটখোলা শাখাটি মতিঝিলের ইত্তেফাক ভবনের দ্বিতীয় তলায়। শাখাটি ২০১৩ সালে চালু হয়। ব্যাংকটি চালু হয় একই বছরে। এই শাখায় বিভিন্ন সময় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠদের পদায়ন করা হতো। তারা বিভিন্ন সময় শাখাটি থেকে বিভিন্ন নামে ঋণ সৃষ্টি করে এস আলমকে সুবিধা দেয়। এখন শাখাটির আমানতের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা ও ঋণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। ঋণের সিংহভাগ বিভিন্ন নামে এস আলম গ্রুপ নিয়ে গেছে বলে ব্যাংকটির তদন্তে উঠে এসেছে। ফলে ব্যাংকটি গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে সমস্যায় পড়েছে।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, এর মধ্যেই জানাজানি হয় কয়েকজন গ্রাহকের নামে ঋণ রয়েছে, তবে তারা ঋণের টাকা বুঝে পাননি। গত কয়েক দিনে এমন ১২-১৫ জন গ্রাহক ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের নামে প্রায় এক কোটি টাকা ঋণের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ জন্য তারা ব্যাংকটিকে ঋণ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা এতে রাজি হননি। এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার গ্রাহকরা কর্মকর্তাদের আটকে রাখেন। ২০২৩ সালে শাখাটির ব্যবস্থাপক ছিলেন জাকির হোসেন। তাকে ইতোমধ্যে বরখাস্ত করেছে প্রধান কার্যালয় সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আগে কর্মরত ছিলেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে জাকির হোসেন আমার দেশকে বলেন, যেটা হয়েছে, সেটা ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে। আমি এক বছর দায়িত্বে ছিলাম। আমার আগে আরো তিনজন ছিল। একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাকি দুজন অবসরে। আমাদের তারল্য সংকট ৫ আগস্টের পর নয়। এটা আরো আগে থেকে শুরু হয়েছিল। যেসব ঋণ বিতরণ হয়নি, সেখানের টাকা আমরা অন্য জায়গায় টান্সফার করেছি। কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে ব্যাংককে। বাকি টাকাও বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেকের নামে ঋণ রয়েছে, তবে তারা ঋণ পাননি বলে জানাচ্ছেন। প্রধান কার্যালয় বিষয়টি তদন্ত করছে। এরপরই পুরো তথ্য পাওয়া যাবে।
ব্যাংকটির বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক এএনএম সাদান জাহানকে একাধিকবার কল করা হলেও রিসিভ করেননি। পরবর্তী সময়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেও উত্তর দেননি।
ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির আমার দেশকে বলেন, এটা পুরোনো ইস্যু। এ ঘটনায় এক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে অভিযোগ দেওয়া ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে বলে শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।
২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংক কার্যত এস আলম গ্রুপের দখলে ছিল। গ্রুপটির কর্ণধার সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম মাত্র ২৪ বছর বয়সে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন, যা তাকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সি ব্যাংক চেয়ারম্যানে পরিণত করে। এর আগে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং নির্বাহী কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। পরে চেয়ারম্যান হোন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. সেলিম উদ্দিন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হয়েছেন ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক এমডি মু. ফরীদ উদ্দীন আহমদ।
বর্তমানে ব্যাংকটি চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তার ছয় মাস আগেও এ পরিমাণ ছিল মাত্র এক হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০০ গুণ। এ ঋণ এখন ব্যাংকের মোট ঋণের ৮৭ শতাংশ, যা আগের ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ থেকে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকটি। ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণই বিতরণ হয়েছে চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিকভাবে মোট ঋণের ৫৬ শতাংশ। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে গেছে।