
১৩ এপ্রিল ২০২৩ সাল। বৃহস্পতিবার বিকেল। ঈদের বাকি আর মাত্র এক সপ্তাহ। আমরা বসে আছি আসাহা নামে খার্তুমের একটা লেবানিজ রেস্তোরাঁয়। আমাদের খার্তুম অফিসের সব সহকর্মী একসঙ্গে ইফতার করছি। পাশের টেবিলে আমাদের মতো আরেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীরাও হইচই করে ইফতার করছেন। বেশ উত্সবমুখর পরিবেশ।
গত ছয়টি মাস খার্তুম ছিল রাজনৈতিকভাবে অশান্ত। এই অস্থিরতার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সংক্ষেপে বললে, সুদানের সেনাবাহিনী আর র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স বা আরএসএফ নামে প্যারামিলিটারি গোষ্ঠী ২০১৯ সালে সে দেশের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শাসক ওমর আল–বশিরকে বন্দী করে। এরপর তারা এ সমঝোতায় আসে যে তাদের সমন্বয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দুই বছর পরে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু সময় গড়ালে দুটি গোষ্ঠীই ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পরস্পর জড়িয়ে পড়ে তীব্র সংঘাতে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে রোজার কয়েকটা দিন খার্তুম শহর তবু কিছুটা শান্ত। অবশ্য এ দিন সকালের দিকে হঠাৎ করেই শহরের পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল। আরএসএফের সশস্ত্র সদস্যরা সেনাবাহিনীর নর্দান স্টেটের মারায়ি বিমানঘাঁটি দখল নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল, বিষয়টির সুরাহা হয়ে গেছে। ঈদের আগে ১৬ এপ্রিল সেনাবাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে একটা সমঝোতা হতে চলেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে কোনো কিছুরই সুরাহা হয়নি, সেটি তখনো আমরা জানি না।
যুদ্ধের সূচনা
পরের দুটো দিন সাপ্তাহিক ছুটি। আমার স্ত্রী দিলরুবা ইয়াসমিনকে নিয়ে ঈদের বাজার–সদাই করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সে কারণে ইফতারের পর অফিসে ফিরে গিয়ে কিছু টাকাপয়সা তোলার কথা। সারা দিনের কাজের চাপে টাকা তোলার কথা মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। সুদানে বিদেশিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে বেশ জটিলতা ছিল। এ কারণে আমরা দৈনন্দিন খায়খরচার টাকা অফিস থেকেই তুলতাম। কিন্তু ইফতারের টেবিলে আমার চিফ ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার জানালেন, তাঁকে জরুরি কাজে শ্বশুরবাড়ি যেতে হচ্ছে। এ জন্য তাঁর পক্ষে ইফতারের পর অফিসে ফেরত যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ভদ্রমহিলা আইরিশ নাগরিক, তাঁর স্বামী সুদানিজ। তাঁর শ্বশুরবাড়ি খার্তুম শহরের কাছেই। তিনি অফিসে যাবেন না বলে আমার টাকা তোলার কাজটা মুলতবি রয়ে গেল।
একদিন পর শনিবার দিলরুবা আর আমি সপ্তাহের বাজার করতে বের হলাম। খার্তুম শহর কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। আমরা থাকি খার্তুম এরিয়া টু নামে একটি অঞ্চলে। আমাদের অফিস খার্তুম এরিয়া টুতে হওয়ায় আমরাসহ কিছু আন্তর্জাতিক কর্মী এই এলাকায় থাকি। গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর লক্ষ করলাম, দূরে কোথাও বড়সড় আগুনের কুণ্ডলী। একই সঙ্গে কানে আসতে থাকল গোলাগুলির আওয়াজ। অবাক হলাম। আমরা জানতাম, রমজানের সময় সাধারণত সেনাবাহিনী, আরএসএফ বা অন্য আদিবাসীরা যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকে। তা ছাড়া ১৬ এপ্রিল তো সেনাবাহিনী আর আরএসএফের মধ্যে সমঝোতাই হতে চলেছে। তাহলে হঠাৎ কী এমন ঘটনা ঘটে গেল?
দেখতে পেলাম রাস্তাজুড়ে আরএসএফের সদস্যদের গাড়িবহর বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সুবিধাজনক বলে মনে হলো না। তৎক্ষণাৎ গাড়ি বাড়ির দিকে ফেরাতে বললাম। রাস্তায় সৈন্যবহরের কারণে অনেক ঘুরপথে বাড়ি ফিরে আসতে হলো। গাড়িতে বসেই দেশি–বিদেশি সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দিলাম। জানার চেষ্টা করলাম তারা এ মুহূর্তে কে কোথায়? প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া, হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করা—এসব চলতে লাগল সারাটা পথে। কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে সব স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহকর্মীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।

ঘরে পৌঁছানোর পরপর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে শুরু করল। গোলাগুলির আওয়াজে কান পেতে রাখা দায়। আরএসএফ ততক্ষণে আমাদের এলাকাসহ আশপাশের বেশ কিছু অঞ্চলের দখল নিয়ে নিয়েছে। আর মর্টার ও বিমানযোগে সেনাবাহিনী মুহুর্মুহু হামলা চালাচ্ছে বেদখল হয়ে যাওয়া এসব এলাকায়। বুঝলাম, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা পড়েছি সেই যুদ্ধের ফাঁদে। সমঝোতা বা আলোচনা ছিল মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার ফন্দি।
যুদ্ধবিধ্বস্ত নানা দেশে বহুদিনের কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রথমেই সব কটি ডিভাইসে চার্জ দিয়ে রাখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম, ঘরে খাদ্য আর পানির মজুত কতটা। শৌচাগারগুলোর ড্রামে পানি ভরে রাখলাম। বিকেলের দিকে সত্যি সত্যি বিদ্যুৎ চলে গেল। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টসহ আশপাশের বেশ কিছু বাড়িতে জেনারেটর থাকায় প্রথম দিনটা পার হলো বড় কোনো সমস্যা ছাড়াই। আমি অবশ্য বাড়িওয়ালাকে একবার বলার চেষ্টা করলাম, জেনারেটর একটু রেশনিং করা যায় কি না। পরিস্থিতি ঠিক হতে কত দিন লাগে, কে জানে? বাড়িওয়ালা পরিস্থিতি তখনো সম্পূর্ণ আঁচ করে উঠতে পারেননি। বিদেশি ভাড়াটের কথায় তিনি কান দিলেন না। জেনারেটর চলল একনাগাড়ে। পরদিনই জেনারেটরের তেল শেষ। বিদ্যুৎ আসার কোনো নামগন্ধ নেই। আমরা ওয়াই–ফাই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। মোবাইল নেটওয়ার্কই তখন একমাত্র ভরসা। ভাগ্য ভালো, মোবাইল নেটওয়ার্ক তবু সচল।
আমাকে অফিস আর সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে, হেডকোয়ার্টারকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে হচ্ছে। দেশি–বিদেশি মিলিয়ে আমাদের অফিসের কর্মী প্রায় আড়াই শ জন। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব দেশ–বিদেশ থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করছে। অতি ব্যবহারে মোবাইলের চার্জও কমে আসতে শুরু করেছে। আমি ডিভাইস ব্যবহারে রেশনিং শুরু করলাম। প্রথমে ল্যাপটপে যোগাযোগ, এরপর অফিসের মোবাইল, তারপর নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল—এভাবে চলতে লাগল। ঠিক করলাম, দেশে মাত্র একজন আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। তিনি বাকি সব আত্মীয়দের কাছে খবরাখবর পৌঁছে দেবেন।
আমাদের একমাত্র সন্তান থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। তার সঙ্গেও ফোনে কথা বলতাম না। এর বিশেষ কারণ ছিল। আমাদের বাসার ঠিক কোনায় আরএসএফ চেকপোস্ট বসিয়েছে। আরেক দিকে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি। সেখান অ্যান্টিএয়ারক্রাফট গান থেকে বিমান লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গোলা ছোড়া হচ্ছে। গোলাগুলি চলছে মুষলধারে। এ অবস্থায় কথা হলে আমাদের ছেলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে ফেলবে। ওকে মানসিক চাপে দেওয়ার কী দরকার! আমরা এসএমএসের মাধ্যমে ন্যূনতম একটা যোগাযোগ রাখছিলাম।
আমাদের বাড়িগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে ড্রয়িংরুম আর বেডরুমগুলো রাস্তার দিকে; রান্নাঘর পেছনের সিঁড়ি ও লিফটের দিকে। রাস্তার দিকটা ভীষণ অনিরাপদ। যেকোনো সময় ঘরে গুলি ঢুকে যেতে পারে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পেছনের দিকটায় যেখানে রান্নাঘর, সেখানেই আমরা থাকব। গোলাবারুদের বিকট আওয়াজও সেখানে মৃদু শোনায়। আমরা রান্নাঘরে তোশক বিছিয়ে, মেঝেতে বিছানা করে থাকতে শুরু করলাম। সেখানেই অফিসের কাজ, খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রাম।

দ্বিতীয় দিন কাজ করছি, হঠাৎ দেখি তোশক কেমন ভেজা ভেজা। খেয়াল করে দেখি, বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজের সব বরফ গলে পানিতে ভেসে যাচ্ছে পুরো রান্নাঘর। দিলরুবা আর আমি দুজনে মিলে অন্য ঘরের আরেকটি তোশক টেনে আনলাম। রান্নাঘর আর শোয়ার ঘরের মাঝখানের সরু করিডরে আপাতত আবাসন গাড়তে হলো।
পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। যুদ্ধের তাণ্ডব বাড়ছে প্রতিমুহূর্তে। একদিন খবর এল আমাদের এক সহকর্মীর বাড়িতে হামলা হয়েছে। আরও শুনতে পেলাম, আরএসএফের লোকেরা বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে খাবারদাবার, পানি এসব নিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা থেকে মানুষজনকে লাঞ্ছিত করার খবরও কানে এল। এসব শুনে টেবিল, চেয়ার, টুল ইত্যাদি যা যা পাওয়া গেল, তা দিয়ে বাড়ির সদর দরজা শক্ত করে আঁটার চেষ্টা করা হলো। আমরা বুঝতে পারছিলাম, এটা কোনো প্রতিরোধই নয়, তবু মনকে প্রবোধ দেওয়া।
খবর পেলাম, বিদেশি এক সহকর্মীর বাড়িতে রাখা আমাদের অফিসের ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটা আরএসএফের লোকেরা নিয়ে গেছে। আরেকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের চারটা গাড়িও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অফিসে লুটপাট হতে শুরু করেছে। আমাদের অফিসের গেস্টহাউস হিসেবে যে অ্যাপার্টমেন্টটা ব্যবহার করা হতো, সেখানেও আরএসএফ ভাঙচুর করে ঢুকে নানা কিছু নিয়ে চলে গেছে।
বুঝতে পারছিলাম, এখানে এভাবে আর থাকা যাবে না। যেকোনো সময় আমরা মারা পড়তে পারি। আমাদের অফিসে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা দুটো গেস্টহাউস আছে। আন্তর্জাতিক কর্মীদের সেখানেই থাকার ব্যবস্থা। আমাদের এক ইতালীয় নারী সহকর্মী জানাল, সে তার গেস্টহাউসে একা থাকতে নিরাপদ বোধ করছে না। গেস্টহাউসে আমাদের তিনজন নারী সহকর্মী থাকতেন। কিন্তু যুদ্ধের শুরুর আগেই মাঠ পরিদর্শনের কাজে দুজন চলে গিয়েছিলেন পশ্চিম দারফুরে। মেয়েটির অসহায়ত্বের কথা শুনে গেস্টহাউসের বাড়িওয়ালি তাঁকে তাঁর বাড়িতে এসে গিয়ে থাকার পরামর্শ দিলেন। পরিস্থিতি বিচার করে সাময়িকভাবে সেটাই যৌক্তিক বলে মনে হলো। সে রকম একটা বন্দোবস্ত হলো।
কঠোর রেশনিংয়ের পরেও ঘরের খাবার প্রায় ফুরিয়ে আসছিল। চাল–ডাল তো আগেই শেষ। শুকনো খাবারও প্রায় তলানির দিকে। রান্নাঘরের তাকে খালি পানির বোতলের সংখ্যা বাড়ছে। এভাবে কীভাবে থাকা যায়! সব আন্তর্জাতিক সংস্থাই খার্তুম থেকে বেরোনোর কথা ভাবছে, কেউ কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না।
সেই দিশাহীন সময়ে একটা খবর পেলাম। মানবিক পরিস্থিতির কারণে শিগগিরই নাকি যুদ্ধবিরতি হবে। খার্তুম থেকে বের হওয়ার এটাই সুযোগ। খবর এল, যুদ্ধরত দুই পক্ষ ১৯ এপ্রিল যুদ্ধবিরতির জন্য একমত হয়েছে। কিন্তু কোথায় কী? ১৯ তারিখে গোলাগুলি বা বোমাবর্ষণ কিছুই থামল না। এদিকে আমার ঘরে পানির সঞ্চয় প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। আমরা দুজনার জন্য আর মাত্র কয়েক গ্লাস পানি হয়তো অবশিষ্ট আছে। খুবই হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এল ২০ এপ্রিল। এটাই শহর ছাড়ার সুযোগ। আশপাশের অন্যান্য অফিসের লোকজনও শহর ছাড়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শহর ছাড়ব বললেই আমার পক্ষে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাওয়া কঠিন। কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে সব সহকর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত না করে কি আমার পক্ষে চলে যাওয়া সম্ভব? আগেই বলেছি, সুদানিজ ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে আমার সহকর্মী ২৫০ জন। তাঁরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে খার্তুমসহ সুদানের আশপাশের বেশ কিছু অঞ্চলে। সহকর্মীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খার্তুমে আছি আমরা মোট ১৭ জন। পশ্চিম দারফুরে আছেন দুজন সহকর্মী। একজন মালাউইর, আরেকজন ইথিওপিয়ার। কেনিয়ার এক সহকর্মী আটকা পড়ে আছেন পশ্চিম কর্দোফানে। এদের কোনো ব্যবস্থা না করে খার্তুম থেকে আমরা বেরিয়ে যাই কী করে?
বিদায় খার্তুম
আমাদের বেশির ভাগ সুদানিজ সহকর্মী তত দিনে শহর ছেড়ে চলে গেছে। কেউ নিজের গ্রামে, কেউ আত্মীয়ের বাসায়, কেউবা অন্য কোনো নিরাপদ অঞ্চলে। খার্তুমে রয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক সহকর্মী আর তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা। তাঁরা জার্মানি, ইতালি, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ডসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। আমার ইতালীয় সহকর্মীকে যে বাড়িওয়ালার বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম, শুনতে পেলাম খার্তুমে তিনি আর নিরাপদ বোধ করছেন না। পরিবার–পরিজন নিয়ে তাঁরা ওয়াদ মাদানি নামের একটা জায়গায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতালীয় সহকর্মীকে যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে তাঁর বাড়ি থেকে কীভাবে নিয়ে আসব? সেই বাড়িতে তাঁকে একা রাখাও তো সম্ভব নয়। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লাম। এমন একটা অনিশ্চিত অবস্থায় বাড়িওয়ালি প্রস্তাব দিলেন, আমরা রাজি থাকলে তাঁরা আমার সহকর্মী মেয়েটিকেও সঙ্গে করে ওয়াদ মাদানিতে নিয়ে যেতে পারে। অনেক চিন্তাভাবনা আর আলাপ–আলোচনার পর ঠিক হলো, সে মুহূর্তে ওটা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো সমাধান নেই। ওয়াদ মাদানি ইথিওপিয়ার সীমান্ত থেকে ঘণ্টা আটেক দূরে। ওখানে তখনো যুদ্ধ শুরু হয়নি। সময়–সুযোগমতো আমার সহকর্মীটি যদি কোনোমতে ইথিওপিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, তাহলে আমাদের ইথিওপিয়া অফিসের কর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করতে পারবে।
আমার এক আইরিশ সহকর্মী ছিলেন সাত–আট মাসের গর্ভবতী। তিনি রয়ে গেলেন তাঁর সুদানিজ শ্বশুরবাড়িতে। তাঁর শ্বশুরবাড়ি তখনো পর্যন্ত ছিল নিরাপদ এলাকায়। এই শারীরিক অবস্থায় তিনি আমাদের সঙ্গে কোথাও যেতে চাইলেন না।

ইতালি আর আয়ারল্যান্ডের এই দুই সহকর্মী ছাড়া নিজের পরিবারসহ বাকি মোট ১২ জনকে এখন আমার এই শহর থেকে নিরাপদ কোথাও বের করে নিয়ে যেতে হবে। প্রশ্ন হলো, কোথায় যাব, কখন যাব, কীভাবে যাব? অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজনের আর খার্তুমবাসী সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক হলো, আমরা যাব আল মামুরা। আল মামুরা খার্তুমের প্রান্তবর্তী অঞ্চল। অনেকটা ঢাকার পাশে আশুলিয়ার মতো। সেখানকার পরিস্থিতি তখনো অতটা খারাপ হয়নি; অন্তত যুদ্ধ চলছে না। স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় আল মামুরায় একটা বাড়ি ভাড়া করা হলো।
এবার রওনা দেওয়ার পালা। সমস্যা বাধল এখানেই। আমাদের ১২ জনের জন্য দরকার অন্তত তিনটা গাড়ি। আমার এক সহকর্মীর বন্ধু জানালেন, তিনি তাঁর একটা গাড়ি দিতে পারবেন। তিনি নিজেই সেটা চালিয়ে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। অন্য আরেকজন সহকর্মী অফিসের গাড়ি নিয়ে যাবেন বলে ঠিক হলো। আরও একটা গাড়ি আমাদের দরকার। বহু কষ্টে একটা মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করা হলো। পরিস্থিতি বুঝে মাইক্রোবাসের চালক অবিশ্বাস্য ভাড়া হাঁকলেন। গত্যন্তর ছিল না বলে তাঁর শর্তেই রাজি হতে হলো। যা–ই হোক, একটা ব্যবস্থা অন্তত হলো।
আমার মাথায় তখন অন্য একটা চিন্তা। হাতে তো বড় অঙ্কের টাকা থাকা দরকার। সেটা পেতে হলে আমাকে যেভাবেই হোক অফিসে যেতে হবে। এ ছাড়া আমাদের সবার পাসপোর্ট অফিসের প্রশাসন বিভাগে রাখা। সেগুলোও আনতে হবে। অফিসের ইমার্জেন্সি ভল্টের চাবি আমার কাছে। সেখান থেকে টাকাপয়সা ওঠাতে হবে।
ঠিক হলো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলতে আন্তর্জাতিক সহকর্মীরা অফিসে আসবেন। সেখান থেকে একটা মাইক্রোবাসে করে আমরা সবাই আল মামুরার পথে রওনা দেব। এখানে একটা বড় সমস্যা দেখা দিল। মাইক্রোবাসটিকে প্রথমে অফিস থেকে আমার বাড়ি আসতে হবে। সেখান থেকে আমাদের তুলে নিয়ে অফিসে যেতে হবে। আমার বাড়ির একদিকে তো চেকপোস্ট আর অ্যান্টিএয়ারক্রাফট গান বসানো। মাইক্রোবাসটিকে সেসব পার হয়ে আসতে হবে। আমাদের তুলে আবার ওগুলো পার হয়ে অফিসে যেতে হবে। অফিস থেকে আবার সেই একই পথ পেরিয়ে সবাইকে নিয়ে আল মামুরার দিকে রওনা হতে হবে। এতবার করে এই জায়গাটা পার হওয়ার সাহস কেউ পেল না। টাকাপয়সা হাতে না নিয়ে শহর ছেড়ে যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখন একটাই উপায়, আমি যদি হেঁটে অফিসে চলে যেতে পারি। দিলরুবাকে নিয়ে হেঁটে অফিস পর্যন্ত যাওয়ার মনোবল পাচ্ছিলাম না। আরবি ভাষায় আমি অতটা সড়গড় নই। চেকপোস্টে একাধারে প্রশ্ন করতে শুরু করলে ওদের সঙ্গে কথা চালানো আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। কী করা যায়? যোগাযোগ করলাম হেডকোয়ার্টারে। ওরা ভরসা দিল, টাকাপয়সা নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে না। ওরা সে ব্যবস্থা করবে। আগে দরকার আমাদের নিরাপত্তা
পরিকল্পনায় আবারও পরিবর্তন এল। ঠিক হলো, মাইক্রোবাসের সহকর্মীরা অফিসে গিয়ে প্রশাসন বিভাগের দরজা ভেঙে সবার পাসপোর্ট জোগাড় করবে। এরপর গাড়ি আসবে আমাদের নিতে।
ঝামেলার যেন অন্ত নেই। আবারও নতুন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। আমার হাঙ্গেরীয় সহকর্মী আর তাঁর সুদানিজ স্বামীরও আমাদের সঙ্গে আল মামুরা যাওয়ার কথা। অথচ ২০ তারিখ সকাল থেকে তাঁদের কোনো খবর নেই। বারবার ফোন দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু ওঁদের দুজনেরই ফোন বন্ধ। আমি নিশ্চিত, ওঁদের কোনো একটা বিপদ–আপদ হয়েছে। আমার আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে একসময় হাঙ্গেরীয় সহকর্মীর ফোন এল। কাঁপা–কাঁপা গলায় তিনি যা জানালেন, তার সারসংক্ষেপ হলো, গত রাতে তাঁর বাড়িতে বোমা পড়ে বাড়ির একটা অংশ উড়ে গেছে। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বাড়ির যেদিকটায় রাতে ছিলেন, বোমা পড়েছে তার উল্টো দিকে। তাঁরা কোনোক্রমে বেঁচে গেছেন। এখন তাঁদের হাতে কোনো ফোন নেই। কোনোরকমে প্রতিবেশীর ফোন থেকে আমাকে বর্তমান পরিস্থিতি জানাতে ফোন করেছে। তাঁর এলাকায় ভয়াবহ গোলাগুলি আর বোমাবর্ষণ চলছে।
এখন কী করব? ওদের জন্য অপেক্ষা করব, নাকি ওদের ছাড়াই রওনা হয়ে যাব? ভালো–মন্দ নানা কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওঁদের ছাড়াই আমরা চলে যাব। পরে কোনোভাবে ওঁদের আনার ব্যবস্থা করা যাবে। কারণ, এ পরিস্থিতিতে ওঁদের জন্য অপেক্ষা করলে বাকি দশজনকে ঘোরতর বিপদের মধ্যে ফেলা হবে। আমার সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর সহকর্মীরা একে একে যে যার জায়গা থেকে অফিসে এলেন। সেখান থেকে ছোট একটা গাড়ি আর মাইক্রোবাসে আমরা রওনা দিলাম।
অফিসের প্রশাসন বিভাগের তালা ভেঙে পাসপোর্ট, শুকনো খাবার আর যতটা পারা যায় পানি নিয়ে তাঁরা আমার বাড়িতে এলেন। আমরা শুনছিলাম, আরএসএফের লোকজন চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে মানুষজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় জোর করে খাবার ও পানি নিয়ে নেয়। কোনো এক অজানা কারণে আমাদের খাবার বা পানি তারা নেয়নি।

ছয় দিন পর খোলা হাওয়ায় প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম। কিন্তু যতই সামনের দিকে এগোলাম, ততই দম বন্ধ হয়ে এল। চারপাশের বাড়িঘর সব বাড়ি–গাড়ি হয় ভাঙা, নয় পোড়া। চারপাশের বিধ্বস্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাই আমরা। পথে কোনো কোনো চেকপোস্টে গাড়ি থামানো আর যৎসামান্য জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া মোটামুটি নির্বিঘ্নেই আমরা আল মামুরায় এসে পৌঁছালাম।
আসার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সহকর্মীরা ইফতারের আয়োজনে নেমে পড়ল। নিজেদের সঙ্গে আনা শুকনো খাবার তো ছিলই। আশপাশের বাজার থেকেও যে যা পারল জোগাড় করে আনল।
আজ শেষ রোজা বলে কথা। কাল ঈদ।
আল মামুরার অনিশ্চিত দিন
গত কয়েক দিনের চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি মিলল ঈদের দিন সকালে। এর মূল কারণ যতটা না ঈদ, তার চেয়ে বেশি ছিল সবার একসঙ্গে একত্র হওয়ার স্বস্তি। খার্তুম অফিসের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক কর্মীরা এখন একসঙ্গে আছি। এটাই মনে বিরাট ভরসা তৈরি করল।
ঈদের দুপুরের রান্নার ভার পড়ল আমি, দিলরুবা আর বাংলাদেশ অফিসে কর্মরত এক বাঙালি সহকর্মীর ওপরে, যিনি অল্প সময়ের জন্য খার্তুম অফিসকে সহযোগিতা করতে এসে এই বিপদের মধ্যে পড়েছেন। সকালের দিকে এক বিদেশি সহকর্মী দোকানে খাসির মাংস পেয়ে তড়িঘড়ি করে কিনে এনেছিলেন। দরকারি মসলাপাতি ছাড়াই সেই মাংস দিয়েই তেহারিজাতীয় কিছু একটা তৈরি করলাম। কেউ কেউ সালাদ বানাতে লেগে গেলেন। বিরাট ঝড়ঝঞ্ঝার পর সবাই ঠাট্টা–মশকরায় মেতে উঠল। নানা গল্পগুজবে পার হয়ে গেল দিনটা।
এর মধ্যেও আমি সুদানের জাতিসংঘ অফিসসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছি। সবার নিকটবর্তী লক্ষ্য হলো আমাদের পোর্ট সুদান পর্যন্ত পৌঁছানো। এর বন্দোবস্ত করাই এখন প্রধান কাজ। পোর্ট সুদানের অবস্থান লোহিত সাগরের পারে। সেখান থেকে সমুদ্র বা আকাশপথে আমাদের যেতে হবে জেদ্দায়। মুশকিল হলো, আল মামুরা থেকে পোর্ট সুদান ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে। যেতে লাগবে ১৪–১৫ ঘণ্টা। এই যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে এতগুলো মানুষ এত দূরের রাস্তা পাড়ি দেব কীভাবে? শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবলেও তো চলবে না। সুদানের নানা জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আমার বাকি সহকর্মীদের বের করে আনার ব্যবস্থাও তো করতে হবে।
আমাদের দুজন সহকর্মী আটকা পড়ে আছেন দারফুর শহরে। কেনিয়ার একজন আছেন পশ্চিম কর্দোফানে। মাঠ পরিদর্শনের কাজে গিয়ে আটকা পড়ে যাওয়ায় ওদের তিনজনের কারও কাছেই পাসপোর্ট নেই। আরেকজন কর্মীর স্ত্রী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান। সে কারণে তিনি থেকে গেছেন সেই সংস্থার গেস্টহাউসে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, সংস্থাটির পরিকল্পনা মোতাবেক তাঁরা পোর্ট সুদানের দিকে রওনা হবেন।
বাড়িওয়ালির সঙ্গে ওয়াদ মাদানিতে চলে যাওয়া আমাদের ইতালির সহকর্মীরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ঠিক করলাম, দারফুরে আটকা পড়া নারী কর্মী দুজনকে জাতিসংঘের সহায়তায় চাদে পাঠিয়ে দেব। আর ওয়াদ মাদানির কাছেই যেহেতু ইথিওপিয়ার সীমান্ত, তাই একটা উপায় করে ইতালির সহকর্মীটিকে ইথিওপিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। গর্ভবতী আইরিশ সহকর্মীটির শ্বশুরবাড়ি খার্তুমের ওমদুরমান নামে একটি অঞ্চলে। নানাভাবে বোঝানোর পরও আমাদের সঙ্গে আল মামুরায় আসতে রাজি হননি। তিনি তাঁর স্বামী আর ছোট সন্তানসহ শ্বশুরবাড়িতেই নিরাপদ বোধ করছেন। আমার পশ্চিম কর্দোফানে থেকে যাওয়া সহকর্মীকে বের করে আনার পরিকল্পনা তখনো আমরা করতে পারিনি।
এসব ব্যবস্থাপনার ফাঁকে আমাদের নিজেদের যাওয়ার প্রস্তুতিও চলছে। জাতিসংঘের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজনদের সবাই মিলে সাব্যস্ত হলো, ২৩ এপ্রিল ভোরে সব সংস্থার গাড়ি, বাস, মাইক্রোবাস ইত্যাদি একসঙ্গে পোর্ট সুদানের দিকে রওনা দেবে। তবে প্রত্যেক সংস্থাকে নিজ নিজ যানবাহনের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। আমাদের কাছে আছে শুধু ছোট দুটি গাড়ি। একটা আমাদের অফিসের, আরেকটা আমাদের এক আইরিশ সহকর্মীর একজন সুদানিজ জার্মান বন্ধুর। যুদ্ধ শুরুর সময়টাতে তিনি আমাদের সহকর্মীর বাড়িতে আটকা পড়েছিলেন। তিনি সঙ্গে থাকায় আমরা বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছি। চেকপোস্টগুলো পার হওয়ার সময় সেনাবাহিনী বা আরএসএফের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলা মধ্যস্থতার কাজগুলো তিনিই সামলেছেন। বিপদের সময় ভদ্রলোক আমাদের জীবনে যেন ত্রাণকর্তার মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। প্রথমে ভাবলাম, তাঁর সহায়তা নিয়ে আরও কয়েকটি গাড়ি জোগাড় করব কি না। কিন্তু পরে অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখলাম, কয়েকটি গাড়ির বদলে একটা বাস জোগাড় করতে পারলেই সুবিধা বেশি। সবাই একসঙ্গে থাকলে মনে একটা নিরাপত্তার বোধ আসে।

কিন্তু কোথায় পাব বারো–চৌদ্দ আসনের বাস? সেই ভদ্রলোকের সহায়তায় একটা বাসের খোঁজ মিলল। বাসের মালিক আমাদের বিপদ বুঝে অনেক টাকা হাঁকলেন। ৯ হাজার ডলারের নিচে কিছুতেই বাস দেবেন না। আমাদের হাতে আছে সাকল্যে দু–তিন হাজার ডলার। বেশি চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সময়ও হাতে নেই। আমরা দেরি করলে অন্য কেউ সেটা হাতিয়ে নেবে। যা আছে কপালে, ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। তখনো জানি না কোথা থেকে এত টাকা জোগাড় করব। ঠিক হলো, ২২ এপ্রিল রাত ১০টার মধ্যে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে বাস আসবে। আমরা আল মামুরার অস্থায়ী ঘাঁটি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে সেদিন দুপুরের পরপর চলে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে যাব। আমাদের এই প্রস্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছিল জাতিসংঘ। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের আল মামুরার তিনটি আঞ্চলিক অফিস ইউনিসেফ, ইউএনডিপি ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থায় এসে জড়ো হবে সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের যানবাহনসহ লোকজন। এই অফিসগুলো থেকে একসঙ্গে আমাদের যাত্রা শুরু হবে ২৩ এপ্রিল ভোরে।

সবই তো ঠিক হলো। কিন্তু আমরা এই ১২ জন এবার ব্যাগ, স্যুটকেস, খাবার এসব নিয়ে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে পৌঁছাব কীভাবে? আমাদের দুটি ছোট গাড়ি তো আছেই। আমাদের কেউ একজন উঁকিঝুঁকি মেরে লক্ষ করেছিল যে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর বেশ বড়সড় একটা গাড়ি আছে। আবার ডাক পড়ল সুদানিজ–জার্মান সেই ভদ্রলোকের। তিনি নানা আলোচনা আর আপসের ভিত্তিতে সেই গাড়ি জোগাড় করে ফেললেন। রফা হলো, আমাদের গাড়ি দুটোর সব তেলের বিনিময়ে তিনি তাঁর গাড়িটি আমাদের ব্যবহার করতে দেবেন। মনে স্বস্তি এল। এবার আমাদের তিনটা গাড়ি। এখন আমরা সবাই একসঙ্গে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে যেতে পারব।
আমরা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় আকস্মিকভাবে দুটি ঘটনা ঘটল। আমাদের সেই গর্ভবতী আইরিশ সহকর্মী হঠাৎ ফোন করে জানালেন, তিনিও আমাদের সঙ্গে সুদান ছাড়তে প্রস্তুত। আমরা সবাই সুদান ছেড়ে চলে যাচ্ছি—এ সংবাদ জানার পর সম্ভবত তাঁর মনে অনিশ্চয়তা ভর করে থাকবে। আমরাও তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই, কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। জাতিসংঘের যানবাহনের সঙ্গে যে আমরা একত্রে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম, সেখানে আগেই আমাদের সবার নাম–ঠিকানাসহ কিছু তথ্য পূরণ করে একটা তালিকা দিতে হয়েছিল। আমরা এই ১২ জনের নামই দিয়েছিলাম। এখন এই শেষ মুহূর্তে ওই তালিকায় নতুন নাম ঢোকানো মুশকিলের কাজই বটে।
এসবের ব্যবস্থা করতে আমি যখন ব্যস্ত, হঠাৎ সামান্য উত্তেজনার আভাস পেলাম। কী ব্যাপার? শুনতে পেলাম, আমার হাঙ্গেরীয় সহকর্মীর সুদানিজ স্বামী বেঁকে বসেছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে দেশ ছেড়ে যেতে নারাজ। কারণ কী? মা, বোন ও পরিবারের অন্যদের নিয়ে তিনি যৌথভাবে বসবাস করেন। দেশের এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে যেতে তাঁর বিবেকে বাধছে। আবার নিজের বিদেশি স্ত্রীকে এই বিপদে একা ছেড়ে দিতেও তাঁর মন সায় দিচ্ছে না। দুদিন আগে যে বোমা পড়ে তাঁদের বাড়ির একটা অংশ উড়ে গিয়েছিল, সেই আতঙ্ক থেকে তাঁদের দুজনের কেউই এখনো ঠিকমতো বেরিয়ে আসতে পারেননি। এ সময়ে স্বামীর এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনে আমাদের সহকর্মীটি ভীষণভাবে ভেঙে পড়লেন। অনেক আলাপ–আলোচনার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, দুজন একসঙ্গে পোর্ট সুদানে যাবেন।
এত সব ঝামেলার মধ্যে আমি অসহায় বোধ করতে থাকি। কে যে শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে আর কে যাচ্ছে না, এর কোনো কূলকিনারা করে উঠতে পারছিলাম না। চূড়ান্ত যাত্রীর তালিকা জাতিসংঘকে কখন পাঠাব, তা নিয়ে ভেতরে অসম্ভব তাড়না চলছিল। এর মধ্যে আল মামুরাতেও যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। জানা গেল, আমাদের ১২ জনের জন্য যে বাসটি জোগাড় করা হয়েছে, সেটির আসনসংখ্যা ৪০টির মতো। বিশাল এই বাস নিয়েই অগত্যা আমাদের পোর্ট সুদান যেতে হবে। আর কোনো উপায় নেই।

গোলাগুলির ভেতরেই বিকেলের দিকে আমরা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে পৌঁছালাম। আইরিশ মেয়েটি তাঁর পরিবার নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আর আসতে পারল না। শ্বশুরবাড়ি থেকে আল মামুরায় আসতে হলে তাঁকে লম্বা একটা সেতু পেরিয়ে আসতে হবে। সেতুর দুই পাশে তখন বিবদমান দুই শত্রুপক্ষ অবস্থান নিয়ে আছে। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ চলছে সেতুর দুধারে। এই গোলাগুলির ভেতর দিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের কাছে আসা তাঁদের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে পৌঁছানোর পর যে চিন্তাটা আমার মাথায় তড়াক করে উঁকি মারল, সেটা হলো সময়মতো সেই বাসটা আসবে কি না, আর এলেও সেটির ৯ হাজার টাকা ভাড়া পরিশোধ করব কীভাবে।
অপ্রত্যাশিতভাবে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেলাম। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে এক আইরিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমরা একটি আইরিশ সংস্থার কর্মী, এ কথা জানার পর তিনি আর তাঁর স্ত্রী আমাদের আপনজনের মতো হয়ে উঠলেন। আমাদের বেশ খোঁজখবর রাখা শুরু করলেন। তাঁদের কথা ভেবে হঠাৎ মাথায় একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল। আমাদের আইরিশ সহকর্মীর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, তাঁর মাধ্যমে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাস ভাড়ার জন্য টাকা ধার চেয়ে দেখতে পারি। অনুরোধ করামাত্র দ্রুতগতিতে তিনি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ইনচার্জের সঙ্গে কথা বলে ছয় হাজার ডলারের ব্যবস্থা করে ফেললেন। মাথা থেকে বিরাট একটা চাপ নেমে গেল। বাসভাড়ার টাকা জোগাড় হয়ে গেছে। এখন আমরা নিশ্চিন্ত।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অফিসে আরও বহু প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা আশ্রয় নিয়েছেন। তাদেরও গন্তব্য পোর্ট সুদান। কিন্তু তখনো অনেকের গাড়ির ব্যবস্থা হয়নি। চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় পার করছেন তাঁরা। পরদিন এই কনভয়ের সঙ্গে যেতে পারবেন কি না, তাঁরা সেটা জানেন না। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার আইরিশ ভদ্রলোক আমাদের অযাচিত সাহায্য করেছেন, আমাদেরও কি উচিত নয় অন্যের বিপদে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আমাদের বাসে আসন ৪০ জনের, আমরা যাচ্ছি মাত্র ১২ জন। ২৬–২৭ জনকে তো আমাদের বাসে সহজেই তুলে নেওয়া যায়। ওখানে এমন অনেকে ছিলেন, যাঁদের পক্ষে পুরো বাস ভাড়া করা সম্ভব ছিল না। হাতে ডলার না থাকায় পোর্ট সুদানে যাওয়ার সুযোগ বা সামর্থ্যও অনেকের ছিল না। আমরা তাঁদের তুলে নিলাম। তাঁরা নিজে থেকে এই যাত্রার খরচে কিছুটা অবদান রাখতে চাইলে আমরা আর বাধা দিইনি। বাসভাড়ার টাকার আরও কিছুটা সাশ্রয় হলো। আমাদের হাতে এখন যে টাকাপয়সা আছে, তা দিয়ে আরও কয়েকটা দিনের খাবার, ওষুধপত্র ও অন্যান্য দরকারি কাজের খরচ চলে যাবে।
পরদিন ভোরে যাত্রা শুরু হলো। বাস, গাড়ি, জিপ ইত্যাদি মিলিয়ে ৭০টির মতো গাড়িতে ছুটল ৭০০ জনের মতো যাত্রী। উদ্বাস্তুদের জীবনে অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য যারা কাজ করে, তারাই আজ উদ্বাস্তুর মতো ছুটছে। পরিবার–পরিজন নিয়ে এ যেন ৭০০ উদ্বাস্তুর এক অনিশ্চিত কাফেলা।
পোর্ট সুদানে যাত্রা
যেকোনো ধরনের পরিস্থিতির জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হলো। আমাদের কাছে যৎসামান্য যা খাবারদাবার আছে, তা–ই ভাগযোগ করে খেয়ে কাটাতে হবে অনিশ্চয়তায় ভরা এই যাত্রা। রাস্তায় গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যেতে পারি। পড়তে পারি ডাকাতের কবলে। হয়তো আর কোনো দিনই পৌঁছানো হবে না পোর্ট সুদানে।
সব ঠিকমতো চললে চৌদ্দ থেকে আঠারো ঘণ্টার মধ্যে লোহিত সাগরপারে পোর্ট সুদানে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের গাড়ির বহর চোখে পড়ার মতো। তাই খুব সাবধানে চারপাশের অবস্থা দেখেশুনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে গাড়ি। তা ছাড়া এই কাফেলায় অনেক নারী, শিশু আর অসুস্থ রোগী। লোকালয় পেলেই নানা প্রয়োজনে গাড়ি থামছে। খাবারের দোকানের দেখা পেলেও গাড়ি থামছে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত এসব লোকালয়ের বেশির ভাগ জায়গাতেই খাবারের তেমন কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। যাওয়াবা পাওয়া যাচ্ছিল, বহরের সামনের দিকের গাড়ির মানুষেরা সামান্য সেসব খাবার কিনতে না কিনতেই সব শেষ। দীর্ঘ সেই যাত্রায় শৌচকর্ম ছিল আরও বিড়ম্বনার। খোলা প্রান্তর পেলে পুরুষেরা তবু দূরে গিয়ে সে জায়গার সদ্ব্যবহার করছিল। নারীদের অবস্থা ছিল দুর্বিষহ। ধু ধু প্রান্তরে চাদর, ওড়না, স্কার্ফ—এসব টাঙিয়ে যৎসামান্য আড়াল তৈরি করে নিতে হচ্ছিল তাদের। এই সময়টাতে দিলরুবাও মানবাধিকারকর্মীর মতোই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। একবারের জন্যও তাঁকে কোনো অনুযোগ করতে শুনিনি। তিনি বরং যতটা পারা যায় অন্যদের সাহায্য করার চেষ্টা করছিলেন।

ষোলো–সতেরো ঘণ্টার পথ প্রায় বত্রিশ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে আমরা পোর্ট সুদানে পৌঁছালাম ২৪ এপ্রিল, সন্ধ্যার একটু পরপর। আমাদের অনেকেই তখন পিপাসায় কাতর, ক্ষুধায় নির্জীব। পুরোটা পথ আমাদের পানি আর খাবার রেশনিং করতে হয়েছে। ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত আমাদের সবার এখন দরকার পানি, খাবার আর বিশ্রাম। মনে হচ্ছে, ঘুমাতে পারলেই বেঁচে যাই। জাতিসংঘ আমাদের সবার থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে পোর্ট সুদানের এক হোটেলে। কিন্তু বিধি বাম। ওখানে পৌঁছানোর পর শুনলাম, বেশি ভাড়ায় হোটেলটির সব রুম নিয়ে নিয়েছে শান্তিরক্ষায় সহায়তা দিতে আসা বিদেশি বিশেষজ্ঞ দল। আমাদের থাকার মতো কোনো জায়গা নেই।
শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। তবু এত ক্লান্তির মধ্যেও সবার জন্য ব্যবস্থা না করে উপায় কী! পরিচিত এনজিওগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে থাকলাম, যদি কেউ থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। কোথাও কোনো আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেল না। সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছি, কী করা যায়। আমাদের হাঙ্গেরীয় সহকর্মীর সুদানিজ স্বামী নিজের মতো করে যোগাযোগ করে আমাদের বারোজনের জন্য এক রাত থাকার একটা জায়গা বের করে ফেললেন। ছোট একটা পরিসরে আমরা সবাই মিলে সেই রাতটা কাটিয়ে দিলাম। বাংলা প্রবাদে বলে না, যদি হও সুজন, তেঁতুলপাতায় ন জন। ক্লান্তির চেয়ে ঘুমের বড় কোনো ওষুধ নেই। সেই ছোট্ট স্থানটিতে পেয়ে গভীর তৃপ্তির নিদ্রা দিলাম।
পরদিন থেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো সীমান্ত পেরোনোর জোগাড়যন্ত্র করতে। পোর্ট সুদান থেকে সমুদ্রপথে ফেরিতে করে আমাদের যেতে হবে জেদ্দায়। ফেরি কখন আসবে, এক ফেরিতে কতজন যেতে পারবে, ফেরি ছাড়ার সময়সূচি কী—সেসবের খবরাখবর নিতে এবং আমাদের সহকর্মীদের নাম ও নাগরিকত্বের তালিকা করতে আমরা সবাই ব্যতিব্যস্ত। আমাদের ইচ্ছা ওই দিনের ফেরিতে ধরার। তাহলে রাতে থাকার বন্দোবস্ত নিয়ে আর ব্যস্ত হতে হয় না। কিন্তু ফেরি পাওয়া গেল না।
এখন কী করব আমরা? আজকে রাতটা কোথায় কাটাব? আগের রাতটা যেখানে ছিলাম, তাদের অনুরোধ করলাম। তারা অপারগ। আরেকটা দলকে তারা অনেক আগেই ঘরটা ভাড়া দিয়ে রেখেছে। আজকের রাত রাস্তায় বসে কাটানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ।
মনে মনে ফন্দি আঁটলাম, আমরা হোটেল কোরালে চলে যাব। ওই হোটেলে আছেন জাতিসংঘের কর্মীরা। ওই হোটেলের লবিতে গিয়ে বসে থাকলে বিপদের মধ্যে কেউ নিশ্চয়ই আমাদের বের করে দেবে না। ওখানে আগে গিয়ে পৌঁছাই। পরবর্তী করণীয় তারপরে ঠিক করা যাবে।
কোরাল হোটেলে গিয়ে আমরা বন্ধুস্থানীয় ও সমমনা জার্মান একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। পোর্ট সুদানে ওদের একটি আঞ্চলিক দপ্তর আছে। ওরা হয়তো থাকা–খাওয়ার সাময়িক একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক বেশ সহৃদয় মানুষ। তিনি তড়িঘড়ি করে তাঁদের গেস্টহাউসে আমাদের বারোজনের মধ্যে পাঁচজনের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। বাকিদের নিয়ে গেলেন তাঁর আঞ্চলিক দপ্তরে। ওখানে হাসপাতালের কিছু ভাঙাচোরা খাট আর টেবিল–চেয়ার জোড়া লাগিয়ে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। আমার আর দিলরুবার থাকার জায়গা ঠিক হলো কান্ট্রি ডিরেক্টরের অস্থায়ী অফিসঘরে। ওখানে দুটি ছোট টেবিল জোড়া দিয়ে খাটের মতো কিছু একটা তৈরি করে দিলরুবার ঘুমানোর ব্যবস্থা হলো। আমি শুলাম মেঝেতে।
এত সবের মধ্যেও সুদানে বিভিন্ন অঞ্চলে আটকে পড়া বাকি সহকর্মীদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ চলছে। আমার সুদানিজ সহকর্মীরা ইতিমধ্যে যাঁর যাঁর মতো নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। দু–চারজনের বাড়িঘর বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও তাঁরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। খবর পেয়েছি, দারফুরে আটকে পড়া আমার দুই নারী সহকর্মী জাতিসংঘের দলবলের সঙ্গে চাদে পৌঁছাতে পেরেছেন। আমাদের চাদ অফিসের সহকর্মীরা যেন সীমান্ত অঞ্চল থেকে তাঁদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়, সে ব্যবস্থাপনা করতে পেরেছিলাম। ওদের সঙ্গে ডলার বা পাসপোর্ট ছিল না বলে এই কয়েকটা দিন খুব আশঙ্কায় ছিলাম। ইতালির সহকর্মীটিও তাঁর বাড়িওয়ালিসহ ইথিওপিয়ার সীমান্ত পার হয়েছেন। আমাদের ইথিওপিয়া অফিসের সহায়তায় ইতালি ফেরার টিকিটও কেটেছেন। হাতে পাসপোর্ট থাকায় তাঁর পক্ষে সবকিছু দ্রুতগতিতে করা সম্ভব হয়েছে। কেবল পশ্চিম কর্দোফানে আটকে পড়া সহকর্মীটির কোনো ব্যবস্থা তখনো আমরা করে উঠতে পারিনি। পশ্চিম কর্দোফান জায়গাটাই এমন যে কাছাকাছি পার হওয়ার মতো কোনো সীমান্ত নেই। সবচেয়ে কাছের সীমান্ত দক্ষিণ সুদানে যেতে হলেও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। এই যুদ্ধের মধ্যে জাতিসংঘের সাহায্য ছাড়া এত সব শহর–বন্দর পাড়ি দিয়ে কোনো দিকে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমি আর আমার হেডকোয়ার্টার নিয়মিত তাঁর খবরাখবর রাখছি।
শোনা গেল, ২৬ এপ্রিল ফরাসি একটি ফেরি আসছে। বিস্তারিত খবর নিয়ে জানলাম, ফেরিটির ধারণক্ষমতা অনেক কম। শিশু, অসুস্থ রোগী এবং যাঁরা পরিবারসহ আছেন, এই ফেরিতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের প্রাধান্য থাকবে। কী একটা শর্তে দিলরুবা আর আমি এই ফেরিতে ওঠার যোগ্য বলে বিবেচিত হলাম। আমাদের স্থানীয় সহকর্মীরাসহ হেডকোয়ার্টারের লোকজন ফেরিতে উঠতে আমাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু সব সহকর্মীকে নিরাপদে পার না করে আমি একা সুদান ত্যাগ করি কীভাবে?
ফরাসি সেই ফেরি চলে যাওয়ার পর আমাদের আসন্ন সুদান ছাড়ার পরিকল্পনা কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। পরবর্তী ফেরি কবে আসবে, সেটাতে আমরা সবাই একত্রে যেতে পারব কি না—এসব প্রশ্ন নিয়ে সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল।
দুই দিন পরে জানতে পারলাম, জাতিসংঘ বহু মানুষের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বড় ফেরি জোগাড় করতে পেরেছে। সেটাতে করে আমরা সবাই সুদান ছাড়তে পারব।
২৮ এপ্রিল এম এস আমানাহ নামের বিশাল সেই ফেরিতে ঠাঁই হলো আমাদের সবার। একজন বাদে সবাই সেই ফেরিতে উঠলাম। আমাদের হাঙ্গেরীয় সহকর্মীর সেই স্বামী কিছুতেই নিজের বিবেককে পরাস্ত করতে পারলেন না। যুদ্ধ–আক্রান্ত দেশটিতে পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যেতে তাঁর মন কিছুতেই সায় দিল না। বিকেল পাঁচটায় ফেরি ছাড়ল। স্ত্রী ফেরিতে। স্বামী পোর্ট সুদানে। সবার চোখের সামনে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মধ্যে স্বামী–স্ত্রী আলাদা হয়ে গেলেন।
শেষ হয়ে হইল না শেষ
আমাদের ধারণা ছিল, এই ফেরিটি কেবল সুদানে কর্মরত জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মীদের জন্য পাঠানো হয়েছে। ওঠার পর দেখা গেল, প্রচুর সুদানিজ ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানুষে ফেরি ঠাসাঠাসি। বেশ কিছু বাংলাদেশির সঙ্গেও দেখা হলো। সুদানে তাঁরা নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত।
ফেরিতে বসার কোনো জায়গা নেই। মানুষ গিজগিজ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফেরির শৌচাগার বন্ধ হয়ে গেল। শৌচাগারের নোংরা উপচে ফেরি সয়লাব। না যাচ্ছে কোথাও দাঁড়ানো, না যাচ্ছে বসা। দিলরুবাকে নিয়ে সিঁড়ির এক কোণে কোনোক্রমে গুটিসুটি মেরে বসলাম। হিমবাতাসের ঝাপটায় হাত–পা জমে যাচ্ছে। সুদানে স্বল্প সময়ের জন্য আসা আমাদের বাংলাদেশ অফিসের এক সহকর্মী দৌড়াদৌড়ি করে আমাদের খাবারের জোগাড়যন্ত্র করলেন। এত দিনের উত্কণ্ঠা আর ক্লান্তিতে আমার শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছিল। সিঁড়ির কোনায় বসে থাকতে থাকতে আমার যে কী হয়েছিল, তা আমি আর জানি না।
হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কিতে আমার ঘুম ভাঙল। উঠে দেখি, ভয়ে দিলরুবার চোখ–মুখ ফ্যাকাশে। আসলে আমি এতই অবসন্ন ছিলাম যে অনেকটা অচেতনমতো হয়ে পড়েছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে আমার সাড়াশব্দ না পেয়ে সে ভেবেছে, আমি আর নেই।
প্রায় ২১ ঘণ্টার সমুদ্রযাত্রা শেষে ২৯ এপ্রিল বেলা তিনটার দিকে আমরা জেদ্দায় পৌঁছালাম। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়া হলো। ফুল, পানি আর শরবত দিয়ে বরণ করা হলো আমাদের। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হলো বিমানঘাঁটিতে।
জাতিসংঘ একটা বিমানের ব্যবস্থা করেছে। সেদিন সন্ধ্যায় সেটি আমাদের নিয়ে উগান্ডা হয়ে কেনিয়া যাবে। উগান্ডায় একজন যাত্রী নেমে যাবেন, আর আমরা বাকি সবাই যাব নাইরোবি। ওমান এয়ারলাইনসের সেই ফ্লাইটে আমাদের মতো আরও বহু মানবাধিকার সংস্থার কর্মীরা একসঙ্গে যাব। বিমানঘাঁটিতে পুরোনো বহু সহকর্মীসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চেনা–পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের সংস্থার এক সাবেক কর্মীর সঙ্গেও দেখা হলো বহুদিন পর। বছর কয়েক আগে অদ্ভুত এক বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী নিখোঁজ হয়েছিলেন। সে সময় তিনি আমাদের সহকর্মী। আমরা সবাই তাঁর পরিবার নিয়ে খুব উত্কণ্ঠিত ছিলাম। তাঁর সঙ্গে দিলরুবা আর আমি গল্প করে বেশ অনেকটা সময় কাটালাম। তিনিও একই বিমানে আমাদের সঙ্গে কেনিয়া যাবেন।
জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় ওমান এয়ারলাইনসের জরুরি বিমান জেদ্দায় এসে পৌঁছায় সন্ধ্যার পরপর। সেই বিমানে আবার আমরা যাত্রা শুরু করি রাত প্রায় নয়টার দিকে। ঘণ্টাখানেক চলার পর হঠাৎ পাইলটের ঘোষণা আসে, বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে। বিমান ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে জেদ্দায়। যাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দেয়। বিশেষ করে ওই সাবেক কর্মীটি সঙ্গে থাকায় আমাদের সহকর্মীদের মধ্যে আতঙ্কটা ছড়াল বেশি।
আমরা আবার জেদ্দায় ফিরে এলাম। ইমিগ্রেশনের ল্যাঠা চুকিয়ে ইউএনএইচসিআরের একটা হোটেলে পৌঁছালাম শেষরাতের দিকে। পরের সারাটা দিন কাটল পরবর্তী বিমানের অধীর অপেক্ষায়। ৩০ তারিখ দুপুরের পর আবার বিমানে চড়লাম আমরা। নাইরোবি এসে পৌঁছালাম ১ মে।
কেনিয়া অফিসের স্থানীয় সহকর্মীরা আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। থাকার আরামদায়ক ব্যবস্থা করলেন। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, পশ্চিম কর্দোফানে আটকে পড়া সেই সহকর্মী দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ সুদানে এসে পৌঁছেছেন। পরিকল্পনামতো তিনি ২ মে উগান্ডা আসবেন। সেখান থেকে কেনিয়ায় পৌঁছাবেন ৩ মে। খবরটা শোনার পর আমার বুক থেকে ভারী জগদ্দল পাথরটা নেমে গেল। যাক, আমি আমার সব সহকর্মীকে সুদান থেকে নিরাপদে বের করে আনতে পেরেছি। পরমের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
পরের দশটা দিন আমরা নাইরোবি থেকে গেলাম। এরপর আমাদের কী করণীয়, তা নিয়ে হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে আলোচনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে দেশে পৌঁছে দিয়ে আমিসহ আরও তিনজন আবার ফেরত যাব সুদানে। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব থেকে আমরা পিছিয়ে যেতে পারি না। যুদ্ধাহত সুদানের সাধারণ মানুষের জন্য, তাদের মৌলিক অধিকারের জন্য আমাদের কাজ করে যেতেই হবে।
সুদানে যুদ্ধের সূত্রপাতের ২৭ দিন পর ১২ মে ২০২৩ আমরা নিরাপদে ঢাকায় অবতরণ করলাম।
দিলরুবাকে দেশে রেখে ৩০ মে ফিরে গেলাম কেনিয়ায়। সেখান থেকে ১২ জুন আবার রওনা দিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানে। সে আরেক অভিজ্ঞতা। সে গল্প অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।