
চারদিনের এক সরকারি সফরে ২৬ মার্চ চীন যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।চারদিনের এক সরকারি সফরে ২৬ মার্চ চীন যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম।
প্রধান উপদেষ্টা এমন এক সময়ে এ সফরে যাচ্ছেন যখন চীন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে করা চুক্তি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন করে কোনো ঋণ সহায়তার চুক্তি হয়নি বাংলাদেশের। এ সময় আগে প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থ ছাড় হয়েছে ২৭ কোটি ডলারের কিছু কম।
গত বছর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে চীন সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল চীনের কাছ থেকে ২০ বিলিয়ন (২ হাজার কোটি) ডলারের ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে। যদিও সে সময় দেশটি থেকে ঋণ সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে মোটে ১ বিলিয়ন ইউয়ানের (বর্তমান বিনিময় হারে প্রায় ১৪ কোটি ডলার)। গত দুই অর্থবছরে এটিই ছিল চীনের কাছ থেকে পাওয়া একমাত্র ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি, সেটিও আনুষ্ঠানিক নয়, মৌখিক। এ সময় আগে প্রতিশ্রুত ঋণের কিছু অর্থ ছাড় হলেও তা হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে।
এমন প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ বিকালে চীনের উদ্দেশে রওনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। এ বিষয়ে গতকাল এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফর নিয়ে পরে বিস্তারিত জানানো হবে। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৬ মার্চ বিকালে প্রধান উপদেষ্টা চীনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। ২৭ মার্চ তিনি বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া অ্যানুয়াল কনফারেন্সের উদ্বোধনী প্লেনারিতে অংশ নেবেন ও বক্তৃতা করবেন। বিকালে চীনের স্টেট কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা রয়েছে। ৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ২৯ মার্চ সকালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি। সেদিন রাতেই তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। তার এ সফরে দ্বিপক্ষীয় আর কী কী বিষয় থাকবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব অংশীদার কাজ করছেন। সফরের আগে এ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।
বাংলাদেশে চীন থেকে নতুন কোনো ঋণ সহায়তার আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি মিলছে না প্রায় দুই অর্থবছর ধরে। বিশেষ করে গত ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের শুরু থেকেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ভঙ্গুরতার ক্ষেত্রগুলো আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিল চীন। পটপরিবর্তন হতে পারে এমন অনুমানও করতে পেরেছিলেন বেইজিংয়ের সরকারসংশ্লিষ্টরা। এ কারণে গত বছরের জুলাইয়ের শুরুতে অনুষ্ঠিত চীন সফরেও অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ঋণ চুক্তির ঘোষণা আসেনি। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগে দেশে ফিরে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের পতনের পর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে চীনের পক্ষ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাস পাওয়ার কথা জানানো হয়। যদিও এ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চুক্তি সই হয়নি।
এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরে দেশটির কাছ থেকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন অনেকেই। আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষক, অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার না আসার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল মনোভাব প্রদর্শন করতে পারে চীন।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক কূটনীতিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো দেশই অন্য কোথাও বড় ধরনের দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ নিয়ে এগোনোর আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকারের উপস্থিতিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দাতা দেশগুলোর মধ্যে সাধারণত ছোটখাটো নানা বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষা করে চলার প্রবণতা দেখা দেয়। সে হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফরে বড় অংকের কোনো সহায়তার প্রতিশ্রুতি না পাওয়া গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে চীন থেকে এ যাবৎকালে পাওয়া অর্থ সহায়তার মোট প্রতিশ্রুতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে গত জুনের শেষ পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৭৩৩ কোটি ডলারের কিছু বেশি। গত অর্থবছরে ছাড় হয়েছে ৪১ কোটি ডলারের কিছু কম। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কোনো প্রতিশ্রুতি না এলেও ছাড় হয়েছে আরো প্রায় ২৭ কোটি ডলার।
বর্তমানে চীনের অর্থায়নে চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্প, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীনে ডবল পাইপলাইনের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপন প্রকল্প, ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুতের সিস্টেম নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, পিজিসিবির সঞ্চালন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং রাজশাহী ওয়াসার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন। এসব প্রকল্পের সবগুলোরই ঋণ সহায়তার চুক্তি সই হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আগে।
প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরের পরিপ্রেক্ষিতে এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে বেইজিংয়ের সমর্থন পাচ্ছে। কারণ চীনারা বুদ্ধিমান। তারা দেখছে এখানে সুযোগ আছে, তাই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরে তাদের পক্ষ থেকে বিশেষ উড়োজাহাজ পাঠানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের ভাবভঙ্গি বেশ ইতিবাচক। অন্তর্বর্তী সরকার বলেই তারা গতি কমিয়ে দেবে, তা মনে হয় না। জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা চীন সফর করে এসেছেন। সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টাকে। অর্থাৎ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের গতি অব্যাহত আছে। প্রকল্প অর্থায়নবিষয়ক কিছু হবে না হয়তো। কারণ এ সরকারের অর্থায়ন উপযোগী প্রকল্প তৈরিও তো করতে হবে। কিন্তু সেটা তো এ সরকারের হাতে নেই। সে সুযোগও সরকার পায়নি। কাজেই এ রকম কিছু না হয়ে দুই পক্ষের জন্য যে সহজ ক্ষেত্রগুলো আছে, সেগুলোই হয়তো অগ্রাধিকারে থাকবে। আমাদের প্রত্যাশার মধ্যে আছে আর্থিক সহায়তা, বাজেট সহায়তা, বাণিজ্য সহায়তা, রোহিঙ্গাবিষয়ক সহায়তা, ছোট প্রকল্পগুলোয় সহায়তা দেয়া, কিছু ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করা—এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আসন্ন সফরের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করা যেতে পারে। তিস্তার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হবে কিনা সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত না। এটি খুব সংবেদনশীল বিষয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সব সময়ই দেখা যায় কোনো একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক সম্পর্ক চীন গড়ে তোলে না। তারা “জনগণের সঙ্গে জনগণের” এবং “সরকারের সঙ্গে সরকারের” সম্পর্ক গড়ে তোলে। যার জন্য আমি মনে করছি যে পিপল টু পিপল যোগাযোগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশে একটি বার্তা দিচ্ছে যে, আমরা তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী এবং সেই গতিটি আরো বৃদ্ধি করতে চাচ্ছি। যে ধরনের প্রটোকল দিয়ে ২৬ মার্চ সকালে চার্টার করা ফ্লাইটে চীন সফরে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা, সেই আন্তরিকতা থেকেই প্রমাণ হয় যে বাংলাদেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল তারা চাচ্ছে সেই সম্পর্ককে তারা নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, বরং একটি অ্যাক্টর হিসেবে দেখেছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক ও দক্ষিণ এশিয়ার একটি অ্যাক্টর হিসেবে বাংলাদেশকে দেখছে বলেই তারা অনুধাবন করতে পারে, বাংলাদেশকে যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের কতটা সম্মান প্রাপ্য।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বড় একটি অংশ হয়ে উঠেছিল তিস্তা মহাপরিকল্পনা। বাংলাদেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক আগে থেকেই আগ্রহ দেখিয়ে আসছে চীন। গত বছর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তার ভারত সফরের আগে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকেও প্রকল্পটি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। ওই সময় ভারত প্রকল্পটির দায়িত্ব পেতে পারে বলে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ মহল থেকে ইঙ্গিতও দেয়া হয়। সে সময় চীন থেকে বড় ধরনের অর্থ সহায়তা আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে এ বিষয়টিও কাজ করে থাকতে পারে বলে অভিমত দিয়েছিলেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এর পর গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। তবে গত মাসে এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন প্রস্তুত আছে। তবে প্রকল্পটা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে। সে সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে বাংলাদেশকেই নিতে হবে। এ নদীর তীরে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষের কল্যাণে তিস্তা প্রকল্প যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।’
ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘বাংলাদেশ ২০২১ সালে একটি প্রস্তাব পাঠিয়ে তিস্তা প্রকল্পে চীনের সহায়তা চেয়েছিল। চীন প্রকল্পটি মূল্যায়ন করে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাল্টা প্রস্তাবে জানায়, প্রকল্পটি সংশোধন করা উচিত। তবে এরপর বাংলাদেশের কাছ থেকে ফিরতি কোনো প্রস্তাব পায়নি চীন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটা গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ সরকার এসেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কেউ তো এ সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, সবাই মেনে নিয়েছে। সুতরাং চীন এখানে আসতেই পারে, কোনো বাধা নেই। তবে তিস্তা বিষয়ে কোনো কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ এ বিষয়টি কঠিন, এখানে ভারতও একটি পার্টনার।’
সম্প্রতি চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপিসহ আটটি রাজনৈতিক দলের নেতারা চীন সফরে গিয়েছেন। এ সফরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির চারজন নেতাও যুক্ত হন। ২২ সদস্যের এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চীন বাংলাদেশকে এক বৈঠকে ২৫ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সে সময়ের দুর্নীতিপরায়ণ সরকার সে অর্থ জনগণের কল্যাণে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আট বছরে তারা এ ২৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার তারা কাজে লাগাতে পেরেছিল। স্বভাবতই আমাদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটি বলতে পারি, রাজনৈতিক অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবে চীন। তারই ফলে তারা এ সফরের আমন্ত্রণটি বাংলাদেশকে জানিয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এরই মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান অনেক দেশে গিয়েছেন। কিন্তু যতদূর জানি এটিই বোধহয় প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। এ থেকে বোঝা যায় এ সফরের গুরুত্ব কত বেশি এবং এ সরকার চীনকে কত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সুতরাং এ সফরকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। আজকের দুনিয়ায় বিশ্বে যে দেশে যেটি ইতিবাচক সরকার, আন্তর্জাতিক মহলে প্রত্যেকেই সেটিকে সমর্থন দিয়ে থাকে। চীনও অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে আমি মনে করি। আর বলাই বাহুল্য, চীনের নীতিই হচ্ছে, যে দেশে যে সরকার থাকে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা। তার কারণ হলো চীন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করে না। বরং সেই দেশের সরকারের সঙ্গে মিলেই কাজ করে থাকে। এটিই চীনের নীতি।’
অনেকটা একই রকম বক্তব্য রেখে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রফেসর ড. ইউনূসের আসন্ন চীন সফরকে আমি খুব তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারত যখন বাংলাদেশের সঙ্গে একের পর এক অসহিষ্ণু ও উসকানিমূলক আচরণ করে যাচ্ছে, তখন আমাদের অন্যান্য বিকল্প বন্ধুদের সঙ্গে দৃশ্যমান সম্পর্কটা জোরদার করার দরকার আছে। চীন ঐতিহাসিকভাবে আমাদের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার, তবে তাদের দৃষ্টিটা বাণিজ্যের দিকেই বেশি কেন্দ্রীভূত থাকে। এবার তারা আমাদের সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তনের পথে সাহায্য ও সমর্থন করলে সেটা হবে নতুন একটা ডাইমেনশন। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সরকার তাদের সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা পাবে বলে আমি আশা করি।’
সম্প্রতি চীন সফর থেকে ফিরেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান। তার ভাষ্যমতে, ‘প্রধান উপদেষ্টার প্রথম চীন সফরকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। এ সংকটকালীন সময়ে উত্তরণের জন্য সফরটি গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করছি। ১০ দিনের চীন সফর থেকে আমাদের মনে হয়েছে, তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন স্তরে উন্নীত করতে আন্তরিক। সেটির অর্থ হলো আমাদের শিল্প, কৃষি, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রযুক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা আমাদের সহযোগিতা করতে চান। এরই মধ্যে উন্নয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে তারা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এটিকে তারা আরো বৃদ্ধি করতে চান। বিশেষ করে এখনো বিনা শুল্কে চীনে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশ করে। আমরা অনেকগুলো ব্যাপারে কথা বলেছি। বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন ঘটানোর জন্য আমরা বলেছি। এছাড়া তিস্তার পানি সংরক্ষণ এবং বাংলাদেশে পানি সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রকল্প আমরা তৈরি করতে পারি কিনা এসব বিষয়ে চীন আগেই আগ্রহ দেখিয়েছিল। এ সফরে সবগুলো বিষয়ে চীনের সংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তারা গুরুত্বপূর্ণ যে বার্তা দিয়েছে তা হলো এখানে কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়, জনগণের সঙ্গে এবং সবগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চান। একই সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন যে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে, সেটিকেও তারা বোঝার চেষ্টা করছেন।’
দেশের বাণিজ্য খাতে সবচেয়ে বড় অংশীদার চীন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য সেখান থেকেই আমদানি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও দেশটি থেকে ১ হাজার ৬৬৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এছাড়া দেশের প্রতিরক্ষা খাতেও বৃহৎ অংশীদার চীন। অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটি কোনো নির্দিষ্ট সরকার নয়, বরং জনসাধারণের পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। সে হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরে দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হওয়ার প্রত্যাশা থাকবে তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের অনেকগুলো বিনিয়োগে চীন জড়িত, কিন্তু তাদের অর্থছাড় কমে গেছে। আমরা দেখেছি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরের পর কথা বলেছেন স্বাস্থ্যের বিষয়ে। আমাদের বিনিয়োগ এবং অর্থছাড় চীনের ক্ষেত্রে কমে গেছে। এটা আমাদের বাড়াতে হবে। আমাদের অর্থনীতি খাদের কিনারায় আছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দরকার হচ্ছে যৌথতা এবং সেখান থেকে আমরা কী করতে পারি। আমাদেরকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পর্ক গড়তে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চীনা দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক সেমিনারে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বা কোনো দেশের অভ্যন্তরে যে পরিবর্তনই হোক না কেন, আমাদের নীতি স্পষ্ট। চীন অংশীদার হিসেবেই থাকবে। আমাদের সহযোগিতা বাংলাদেশ, দেশের জনগণ ও চীনা জনগণের জন্য। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে চীন বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা, ঐক্য ও গণতন্ত্রের বিকাশ দেখতে চায়।’