Image description

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের এক অনিয়ম এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে ৩১ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা ২০০৯ সালের পর সর্বোচ্চ। ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরীক্ষার্থীদের বড় একটি অংশই গণিত ও ইংরেজিতে খারাপ করেছে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, একটি শিশুর গণিত ও ইংরেজির ভিত্তি তৈরি হয় মূলত প্রাথমিক স্তরেই। কিন্তু শিক্ষকের মানসিক প্রস্তুতি, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ও শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা শিক্ষার গুণগত মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অদক্ষ শিক্ষক দিয়ে পাঠদানে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালে করা একটি জরিপে দেখা যায়, প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ শিশু গণিত বিষয়ে একক অংকবিশিষ্ট সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে না। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের দুটি বিয়োগ ও দুটি ভাগ সমস্যার সমাধান করতে পারে না পর্যায়ক্রমে ৭৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও ৯৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ শিশু।

ইংরেজি বিষয়ে ছেলেশিশুর মধ্যে ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং মেয়েশিশুর মধ্যে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের একটি বর্ণও পড়তে পারে না। আর ৮৪ দশমিক ১৫ শতাংশ ছেলেশিশু এবং ৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ মেয়েশিশু তিনটি বা তার কম ভুল উচ্চারণসহ একটি কাহিনী সাবলীলভাবে পড়তে পারে না। শুধু বেসরকারি সংস্থার তথ্যই নয়, শিক্ষার্থীদের এ দুর্বলতার তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সরকারি প্রতিবেদনেও। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ দুই বছর পর পর জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষ এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয় ২০২২ সালে। সে তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৩৯ শতাংশ গণিতে শ্রেণী বিবেচনায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দক্ষতা অর্জন করেছে। আর পঞ্চম শ্রেণীর ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৩০ শতাংশ। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের এ দুর্বলতার অন্যতম কারণ পাঠদানে শিক্ষকদের অদক্ষতা ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের অভাব।

 

Teacher-Chart

 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যেকোনো বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শিক্ষক। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা এমন যে দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত কম, ফলে মেধাবীরা এ পেশায় থাকছেন না এবং যারা থাকছেন তাদের বেশির ভাগই বাধ্য হয়ে থাকছেন। তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষকতায় তাদের আগ্রহের ঘাটতি থাকায় তারা প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো আন্তরিকতার সঙ্গে আয়ত্ত এবং ক্লাসে প্রয়োগ করছেন না, ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিতের জন্য শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে মেধাবীরা এ পেশায় আগ্রহী হন। একই সঙ্গে ইন সার্ভিস ট্রেনিংয়ের পরিবর্তে প্রি-সার্ভিস ট্রেনিং নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ যারা শিক্ষকতায় আগ্রহী তারাই ট্রেনিং গ্রহণ করবেন এবং শিক্ষকতায় যুক্ত হবেন।’

শিক্ষকদের এ ঘাটতির বিষয়টি উঠে এসেছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) গবেষণা প্রতিবেদনেও। ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘মেজারিং টিচারস ইফেকটিভনেস ফর প্রাইমারি টিচার্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী শ্রেণীকক্ষের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, গড়ে মাত্র ১৯ দশমিক ১৪ শতাংশ শিক্ষকের ক্লাস পারফরম্যান্স সন্তোষজনক ছিল। আর মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষকের ক্লাস পারফরম্যান্স। ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের পারফরম্যান্স একেবারেই সন্তোষজনক ছিল না।

জরিপে ১২টি জেলার ২৪টি স্কুল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাতে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, পেশাগত দক্ষতা, পড়ানোর ধরন, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হয়েছিল। এসব শিক্ষকের মধ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ, স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের ১৭ দশমিক ১ শতাংশ, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস ১৮ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষকের শ্রেণী পারফরম্যান্স সন্তোষজনক ছিল।

এর আগে ২০১৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি ও গণিত শিক্ষার পরিস্থিতি নিয়ে দুটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল নেপ। এসব প্রতিবেদনেও শিক্ষার্থীদের এ দুই বিষয়ে দুর্বলতার বিষয়টি উঠে আসে। এসব দুর্বলতার অন্যতম কারণ হিসেবে শিক্ষকদের দক্ষতার ঘাটতিকেই চিহ্নিত করা হয়। ‘ইফেকটিভনেস অব লেসন স্টাডি: এ কেস অব এনহ্যান্সিং কোয়ালিটি অব ম্যাথমেটিকস টিচিং লার্নিং ইন দ্য প্রাইমারি এডুকেশন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অংশ নেয়া গণিত শিক্ষকদের শতভাগই গণিত বিষয়ে পাঠদানকে কঠিন বলে মত দিয়েছিলেন। জরিপে অংশ নেয়া সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরদের শতভাগই বলেছেন, শিক্ষকরা গণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে ডিফিকাল্টি অনুভব করেন।

একই বছর ‘উইকনেস অব গ্রেড থ্রি স্টুডেন্টস ইন ইংলিশ: কজেস অ্যান্ড রেমেডিস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে নেপ। ওই প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার কারণ হিসেবে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষকদের দক্ষতার সীমাবদ্ধতা। জরিপে অংশ নেয়া বেশির ভাগ শিক্ষক জানিয়েছিলেন তাদের ইংরেজি উচ্চারণ এবং শব্দভাণ্ডারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে প্রশিক্ষণ। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬৭টি প্রাথমিক টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধীনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, এখনো প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণের বাইরে।

বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষক সংখ্যা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৩ এবং তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭ জন। তবে এসব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও ক্লাসে তারা অর্জিত জ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ করছেন না।

রাজশাহী পিটিআই ইনস্টিটিউটের সুপারিনটেনডেন্ট মো. রেজাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের শেখাচ্ছি ঠিকই। তারা এখানে ভালো নম্বরও পাচ্ছেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের ক্লাস পারফরম্যান্স আশানুরূপ দেখা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর একটি কারণ হতে পারে এখন যারা শিক্ষকতায় আসছেন তাদের বেশির ভাগেরই প্রথম পছন্দ শিক্ষকতা না এবং একটি বড় অংশ চাকরিতে যোগদানের পর অন্য চাকরিতে চলে যাওয়ার চেষ্টায় বেশি মনোযোগী।’ মো. রেজাউল হকের মতো একই মন্তব্য করেছেন দেশের আরো বেশ কয়েকটি পিটিআই ইনস্টিটিউটের সুপারিনটেনডেন্টরা।

এছাড়া এসব পিটিআই ইনস্টিটিউটেও রয়েছে ইনস্ট্রাক্টরের সংকট। মোট ১ হাজার ৪১ ইনস্ট্রাক্টর পদের মধ্যে ৩৬০টি পদই শূন্য। এছাড়া বাংলা, গণিত ও ইংরেজির জন্য ২০২৩ সালে বিষয়ভিত্তিক ৬৭টি করে ইনস্ট্রাক্টর পদ তৈরি করা হলেও এখন পর্যন্ত এসব পদের সবই শূন্য। ঢাকা পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণই দেয়া হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক ইনস্ট্রাক্টর থাকলে হয়তো এ মান আরো কিছুটা ভালো হতো। মূলত এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষকরা যা শিখছেন ক্লাসে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। মাঠপর্যায়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ অনুযায়ী পাঠদান করেন না। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে মনিটরিং বাড়ানো যেতে পারে। একই সঙ্গে যেসব শিক্ষক ক্লাসে ভালো পড়াবেন তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা এবং যাদের পারফর‌ম্যান্স খারাপ তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। অবহেলার প্রমাণ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’

প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার ভিত। আর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে এ পর্যায়ে মান নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরেই প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীরা ঘাটতি নিয়ে ওপরের শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। এ ঘাটতি তৈরির পেছনে বড় কারণ শিক্ষকস্বল্পতা, প্রি-সার্ভিস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা এবং শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার অভাব। শিক্ষকস্বল্পতার কারণে তারা বেশির ভাগ সময়ই শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ ও যত্ন নিশ্চিত করতে পারেন না। আবার অনেক সময় শ্রেণীকক্ষের বাইরেও তাদের জরিপ-নির্বাচনী দায়িত্বসহ নানা কাজে নিযুক্ত করা হয়, যা বাড়তি চাপ তৈরি করে এবং শ্রেণী কার্যক্রমে ঘাটতি দেখা দেয়।’

প্রি-সার্ভিস প্রশিক্ষণের বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এ প্রশিক্ষণের কথা বলছি। অর্থাৎ শিক্ষক হিসেবে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান শুরুর আগে তাকে প্রশিক্ষিত করা। এতে তিনি প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু ভালোভাবে আয়ত্ত করতে এবং নিজেকে মানসিকভাবে পাঠদানের জন্য উপযুক্ত করতে পারবেন। কিন্তু আমাদের এখানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় পাঠদান শুরুর পর। তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া এসব প্রশিক্ষণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তেমন একটা ফলপ্রসূ হয় না।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষায় মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে হলে আমাদের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মেধাবীরা এ পেশায় থাকেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষকতা করেন। একই সঙ্গে প্রি-সার্ভিস প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষকদের শ্রেণী কার্যক্রমের বাইরে অন্য কোনো কার্যক্রমে যুক্ত না করার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি।’