দেশে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বেড়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। বন্যা আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষ। কুড়িগ্রামে কমতে শুরু করছে নদ-নদীর পানি, তবে এখনও পানিবন্দি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
লালমনিরহাটে বিপদসীমার ওপরে বইছে তিস্তার পানি। এতে জেলার নদী-তীরবর্তী ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধায় আবারও বাড়ছে নদ-নদীর পানি। বন্যার শঙ্কায় আছে স্থানীয়রা। শতাধিক চরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রংপুরে পানি বাড়ায় অনেক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
সিরাজগঞ্জ : উজানে ভারী বর্ষণের ফলে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ ও কাজিপুর পয়েন্টে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ করতোয়া, ফুলজোড় ও বড়াল নদীর পানিও। দ্রুতগতিতে পানি বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরের চরাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। তলিয়ে যেতে শুরু করেছে বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল। ফলে জেলার কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলায় বন্যা আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ।
শনিবার সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৬১ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ২৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা : ১২ দশমিক ৯০ মিটার)।
অপরদিকে কাজিপুরের মেঘাই ঘাট পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১৯ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ২২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৬১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপদসীমা ১৪.৮০ মিটার)। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রণজিত কুমার সরকার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মীর মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যেই ৬৫০ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। তালিকা অনুযায়ী সেগুলো বিতরণ করা হবে।
কুড়িগ্রাম : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত জেলার সব কটি নদ-নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে পানি কিছুটা কমলেও এখনও বিপদসীমা সীমার ওপরে রয়েছে দুধকুমার ও ধরলা নদীর পানি। এতে জেলার ৯টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় নিচু স্থানের ঘরবাড়িগুলো নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবারের সংকটে পড়েছে বানভাসি মানুষ।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়ন কদমতলা গ্রামের হোসেন আলী বলেন, ধানের বীজতলা, পটলের ক্ষেত এখন পানির নিচে। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় নৌকা ছাড়া বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, এই পানি বৃদ্ধির অবস্থা ৩ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। তারপর পানি নেমে যাবে। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, কুড়িগ্রামে বন্যায় ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি এবং নদীভাঙনের শিকার ১৫০০ পরিবার। এসব বন্যাকবলিতদের জন্য সাড়ে ৮ লাখ টাকা, ২৭৫ মেট্রিকটন চাল এবং শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট : কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি আবারও বেড়ে বিপদসীমার ৩ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে লালমনিরহাটে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন নদী-তীরবর্তী এলাকার মানুষ।
শনিবার বিকালে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২.১৫ সে.মি., যা বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদী-তীরবর্তী এলাকায় ও নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এতে জেলার ৫ উপজেলার নদী-তীরবর্তী ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পানি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
গাইবান্ধা : ভারী বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের কারণে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘটসহ প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। ফলে এসব নদ-নদী অববাহিকায় বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলার সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ১৬৫ চর-দ্বীপচরের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, শনিবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি ফুলছড়ির তিস্তামুখ পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি জেলা শহরে নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সদর উপজেলার মোল্লারচর, কামারজানি, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া, এরেন্ডাবাড়ি ও ফজলুপুর ইউনিয়নের শতাধিক চরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে শুরু হয়েছে ভাঙন। ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের খারজানি ও কুন্দেরপাড়া গ্রাম ভেঙে যাচ্ছে। পাশাপাশি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন, কাপাশিয়া ইউনিয়ন, ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের খলায়হারার কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে।
রংপুর : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। রংপুরে বন্যার পানির কারণে ২০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম জানান, শনিবার সকালে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২.৩৫ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সময়ের আলো/আরএস