অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
গত বছর ৫ জন ছাত্র আমার সঙ্গে মাস্টার্সে তাদের থিসিসের জন্য কাজ করেছে। অর্থাৎ এরা ৫ জন আমার ডাইরেক্ট থিসিস ছাত্র। এই ৫ জনের মধ্যে দুইজন মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষে থিসিস জমা দিয়েই আমেরিকায় চলে যায় এবং তারা অনলাইনে থিসিস ডিফেন্স দিয়েছিল। গত পরশু তাদের সবার রেজাল্ট দিয়েছে। পাঁচ জনের সবাই জিপিএ ৩.৮ এর বেশি পেয়েছে। এই বছর আমার সাথে দুইজন থিসিস করছে।
এ পর্যন্ত ৩০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে মাস্টার্সে থিসিস করিয়েছি। এদের মধ্যে ১৭ জনের সাথে আমার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া এদের ৪ জনের সাথে আমার একাধিক এমনকি ৪টি পেপারও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন থিসিস না করলেও আমার সাথে গবেষণায় যুক্ত ছিল এবং তাদের সাথেও আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। আমার সাথে যারা থিসিস অথবা গবেষণা করেছে, এরকম ২৭ জন ছাত্র বর্তমানে আমেরিকায় আছে।
আমার অনেক অনেক ছাত্রছাত্রী আছে, যারা এখন আমেরিকায়- যাদের জন্য রেকমেন্ডেশন লেটার লিখেছি এবং যারা আমার ডাইরেক্ট ক্লাসরুম ছাত্রছাত্রী ছিল। এবার আমার শিক্ষকতা জীবনে সর্বোচ্চ সংখ্যক রেকমেন্ডেশন লেটার লিখছি, যারা দরখাস্ত করছে তারা এখন মাস্টার্সের ছাত্র। মাস্টার্স তাদের শেষ হয়নি। মাঝপথে মাস্টার্স এর ক্লাস ও পড়ার ফাঁকে TOEFL ও GRE দিয়েছে এবং দরখাস্ত করেছে। এসব করতে গিয়ে লেখাপড়া ও থিসিসের জন্য গবেষণার একটু ক্ষতিতো হয়েছেই।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এইবার লক্ষ্য করছি আমেরিকায় যাওয়ার একটা হিড়িক পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ আর দেশে থাকতে চাচ্ছে না। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, এদের কেউই ফিরে আসবে না। আসলে দেশে ফিরে আসার পরিবেশও আমরা তৈরী করছি না। দেশে আসলে চাকরি পাবে, এমন পরিবেশ বাংলাদেশ যারা চালায়- তারা তৈরি করতে পারেনি। তাহলে এই ছাত্রদের তৈরি করে দেশের কি লাভ হচ্ছে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে এদের পেছনে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকার বিনিয়োগ আছে, যে বিনিয়োগের কোনো রিটার্ন নাই। এটাতো অপচয়। অথচ দেশ যদি তাদের মূল্যায়ন করতো, তাদের ফিরিয়ে এনে তাদের যোগ্যতা অনুসারে চাকরি দিত, দেশ উপকৃত হতো। যতদিন মেধার চর্চা, মেধার মূল্যায়ন এ দেশে সঠিকভাবে না হবে- ততদিন দেশ উন্নত হবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বিদেশে চলে যাওয়ার স্বপ্ন। আমি এও দেখতে পাচ্ছি, এদের ফিরিয়ে আনার পরিবেশ তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখলাম না। একটা ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম নেওয়া দেশের জন্য অতি জরুরি। একটি দেশ সুন্দর হওয়ার জন্য একটা থ্রেশোল্ড সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী লাগে। মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য দরকার উচ্চমানের শিক্ষক। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। নাই কি? নাই ভালো মানের শিক্ষক ও গবেষক। অল্প কিছু যা, আছে তাদেরও মূল্যায়ন নেই।
তারা গবেষণা রেখে ৩-৪ জায়গায় পার্ট পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ জায়গাটায় নজর দেওয়া খুবই জরুরি। দুঃখ কি জানেন? সরকার অনেক সংস্কার করতে চাইছে বা করার উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু শিক্ষায় সংস্কার করার কোনো উদ্যোগ নেই। যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি, সেটাতেই সবচেয়ে বেশি অবহেলা।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।