Image description

সৈয়দ আবদাল আহমদ

 

সৌদি-পাকিস্তান নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য আরেকটি অস্বস্তির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। গত এক বছরের ঘটনাবলিতে এমনিতেই নরেন্দ্র মোদি প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্ত। এরপর এই চুক্তি মোদির জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ভারতের পুতুল সরকার শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এই পতন নরেন্দ্র মোদিকে নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। ভারতের জন্য হাসিনার পতন ছিল বড় দুঃসংবাদ। এই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে হলো ভারতকে। যুদ্ধের শুরুতে ভারতের হাঁকডাক সপ্তমে পৌঁছেছিল। যুদ্ধ শুরুর আগেই যেন ভারত যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে—এমন একটা হাবভাব। পেহেলগামের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত আগ বাড়িয়েই পাকিস্তানে আক্রমণ করে বসে। পাকিস্তানও পাল্টা আক্রমণ চালায়।

 

ভারত-পাকিস্তান চার দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১০ মে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় দুই দেশ। যুদ্ধে পাকিস্তান ভারতের রাফায়েলসহ পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। এই খবরে একপ্রকার মুষড়ে পড়ে ভারত। নরেন্দ্র মোদির জবান প্রায় আটকে যায়। তাৎক্ষণিক গা-ঢাকা দেন মোদি। পাঁচ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর ভারত অস্বীকার করলেও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খবরটি যে সত্য, তা মিডিয়াকে জানিয়ে দেন। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। পাকিস্তানের যুদ্ধজয়ের পাশাপাশি ভারতও জয় দাবি করে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে তারা ব্যর্থ হয়। বুকে পাথর চাপা দিয়েই যেন পরিস্থিতি নরেন্দ্র মোদিকে সহ্য করতে হয়েছে।

 

পাকিস্তানের কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ভারতকে একেবারে বেদিশা করে দেয়। এক ভুতুড়ে নীরবতা তৈরি হয় ভারতের পোশাক কারখানাগুলোয়। বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার তেল, অস্ত্র কেনার জন্য ২৫ শতাংশ জরিমানাসহ এই চড়া শুল্ক চাপানোটা ভারতীয় পণ্যের ওপর একধরনের নিষেধাজ্ঞা জারিরই শামিল হয়।

 

টার্গেট, ওয়ালমার্ট, গ্যাপ এবং জারার মতো ব্র্যান্ডের জন্য ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১৬০০ কোটি ডলার মূল্যের যে ‘রেডি-টু-ওয়্যার’ পোশাক রপ্তানি করে ভারত, তার এক-তৃতীয়াংশ তৈরি হয় পোশাক রপ্তানির অন্যতম কেন্দ্র তিরুপপুর শহরে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এই শহরের ব্যবসায়ীরা। এন কৃষ্ণমূর্তির গার্মেন্টস কারখানার মালিক কৃষ্ণমূর্তি বিবিসিকে জানান, তার ক্লায়েন্টরা সমস্ত অর্ডার বন্ধ করে দিয়েছেন। তার কথায়, ‘সেপ্টেম্বরের পর থেকে আর কিছু করার থাকবে না।’

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, চিংড়ি, রত্ন, গহনাসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিকারক দেশ ভারত। ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে নরেন্দ্র মোদির গলায় যেন কাঁটা বিঁধে যায়। কথা বলার শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেন।

এতসব যন্ত্রণার পর ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি মোদির জন্য আরেকটি চপেটাঘাত। এই চুক্তির ফলে নরেন্দ্র মোদির অস্বস্তি আরো বেড়ে গেছে।

 

গত বুধবার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই চুক্তিতে সই করেন। এটিকে ‘কৌশলগত যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি’ হিসেবে বলা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী কোনো একটি দেশ আক্রান্ত হলে সেটিকে দুই দেশের ওপর ‘আগ্রাসন’ হিসেবে দেখা হবে।

 

Pakistan-Soudi

 

সৌদি আরবের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে চুক্তিটি সম্পর্কে বলেন, নতুন স্বাক্ষরিত এই প্রতিরক্ষা চুক্তি বহু বছরের আলোচনার চূড়ান্ত পরিণতি। এই চুক্তির মাধ্যমে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান একে অন্যকে আলিঙ্গন করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিফ মুনির। পাকিস্তান এমন একসময়ে চুক্তিটি করেছে, যার কিছুদিন আগেই পাকিস্তান-ভারত চার দিনের একটি যুদ্ধ হয়।

 

সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানি সেনারা কাজ করেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হচ্ছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। নতুন কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি কয়েক দশকের পুরোনো ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অংশীদারত্বকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বুধবার যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সে রকম একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সবসময় ছিল। চুক্তির পর সৌদি আরব এবং পাকিস্তান—উভয় দেশ খুব খুশি।

 

এই চুক্তির পর ভারত যে অখুশি হয়েছে, তা দেশটির প্রতিক্রিয়াতেই প্রমাণিত। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর এই চুক্তির প্রভাব তারা খতিয়ে দেখবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের জাতীয় স্বার্থরক্ষা এবং সব ক্ষেত্রে ব্যাপক জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 

তবে এই চুক্তির পর নরেন্দ্র মোদিকে লক্ষ করে কংগ্রেসের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ তার বক্তব্যে বলেছেন, কূটনীতিতে ব্যক্তিগত রসায়নই শেষ কথা নয়, তা নরেন্দ্র মোদিকে ফের মনে করিয়ে দিল।

 

সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের এই কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি কূটনৈতিক দিক থেকে আরো এক বড় ধাক্কা। জয়রাম রমেশের মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার ব্যক্তিগত রসায়নের যে উল্লেখ করেন, কূটনীতিতে তা অর্থহীন। পেহেলগামে যেদিন হামলা হয়, সেদিন নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরবে ছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সেই সৌদি আরব প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলেছে।

 

‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করেছেন। নরেন্দ্র মোদি ঘটা করে চীন সফর করলেন। তারপরই চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং বেইজিংয়ের গোপন সামরিক ভবনের দরজা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির জন্য খুলে দিলেন। প্রতিটি ঘটনাই ভারতের নিরাপত্তার জন্য গভীর উদ্বেগের। এসব ঘটনা প্রমাণ করে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত রসায়নের কূটনীতি কতটা ব্যর্থ। সৌদি-পাকিস্তান স্বাক্ষরিত এই চুক্তি ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুই দেশের কেউ আক্রান্ত হলে তা দুই দেশের ওপরই ‘আগ্রাসন’ হিসেবে গণ্য হবে। এসব বিষয়ই ভারতের উদ্বেগের কারণ।

 

অর্থাৎ এক দেশের ওপর আক্রমণ হলে অন্য দেশও সেটিকে নিজের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করবে। এখন যদি সৌদি আরবের ওপর হামলা হয়, তাহলে তা উভয় দেশের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হবে। উভয় দেশের স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী এখন আরো বেশি সহযোগিতা করবে এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করবে। পারমাণবিক দেশ হওয়ায় পাকিস্তান সৌদি আরবের জন্য একটি নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবেও কাজ করবে।

 

পাকিস্তানি কূটনীতিক মালিহা লোধি এই চুক্তির পর বলেছেন, এটা অন্যান্য আরব দেশের জন্যও দরজা খুলে দিয়েছে। সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, তেমনি চুক্তিটির ফলে সৌদি আরবের কাছ থেকে জ্বালানি এবং আর্থিক নিরাপত্তা পাওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর্থিক সুযোগ পাকিস্তানের সামর্থ্যকে শক্তিশালী করবে।

গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে লড়াইয়ের পটভূমিতে এবং বর্তমান বৈশ্বিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশে সৌদি আরবের জন্যও এই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইসরাইলের হামলায় আরব বিশ্বে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও চুক্তিটি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে।

 

অর্থনৈতিক সংকটের সময় পাকিস্তানকে বহুবার সাহায্য করেছে সৌদি আরব। বিনিময়ে পাকিস্তান সৌদি আরবকে নিরাপত্তা সহযোগিতা দিয়েছে। দুদেশ সুন্নি-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং উভয়ের মধ্যে শক্তিশালী ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সৌদি আরব এর আগে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বড় ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রেখেছে বহু বছর। চুক্তির ফলে পাকিস্তান সৌদি আরবের কাছ থেকে অনেক বড় সুবিধা পাবে। জ্বালানি নিরাপত্তা তো আছেই। পাকিস্তান এখন সৌদি আরবের অর্থ সহায়তা ব্যবহার করে তাদের প্রয়োজনীয় আমেরিকান অস্ত্র কিনতে পারে। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনও পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহী। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের সাত গুণের বেশি। এ পরিস্থিতিতে সৌদি আরব থেকে অর্থ-সাহায্য পেলে পাকিস্তান অনেকটা ভারসাম্য আনতে পারবে।

 

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একতরফা পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতকে এখন ভাবতে হবে। কারণ সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে সমর্থন করবে। তাছাড়া লাখ লাখ ভারতীয় সৌদি আরবে কাজ করেন। তাদের কথাও ভারতকে ভাবতে হবে। সৌদিতে প্রবাসী ভারতীয়দের স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি ভারত না ভেবে পারবে না।

 

সৌদি-পাকিস্তান চুক্তিটি মধ্যপ্রাচ্য পারমাণবিক নিরাপত্তার হিসাবও বদলে দিতে পারে। প্রয়োজন দেখা দিলে পাকিস্তান পারমাণবিক সহযোগিতা নিয়ে সৌদি আরবের পাশে দাঁড়াবে। গত ৯ সেপ্টেম্বর কাতারে হামলার মধ্য দিয়ে ইসরাইল কার্যত যেকোনো আরব দেশে আগ্রাসন চালানোর হুমকি দিয়ে রেখেছে। এর আগে ইসরাইল পাকিস্তানকে মোকাবিলায় ভারতের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছে। ফলে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবকে তার নিরাপত্তা স্বার্থের কথা নিজেদের মতো করে ভাবতে হবে। শুধু মার্কিন নিরাপত্তার ওপর ভরসা করাটা উচিত হবে না। তাই সহজভাবে দেখলে এটাই বলা যায়, সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি এ অঞ্চলে ভারসাম্য নিয়ে আসবে। ভারত কিংবা নরেন্দ্র মোদি একে যত বাঁকা চোখেই দেখুন না কেন।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ