মীযানুল করীম
বাংলাদেশে এখন রাজনীতির জোর খেলা চলছে। ৫ আগস্ট গণভবন দখলের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে হিসাব করেছিলেন, শেখ হাসিনা যেভাবে ১৯৭১ সালে দেশে ফিরেছিলেন, এবার শেখ রেহানাও সেভাবে ফিরবেন। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। আওয়ামী লীগের স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই রয়ে গেছে। আর এ দিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কারের কাজে ব্যস্ত। বিএনপি সরকারকে ‘যৌক্তিক’ সময় দিতে প্রস্তুত। বৃহত্তম মিত্র জামায়াতে ইসলামীরও একই কথা। কিন্তু ‘ন্যূনতম’ কত দিন থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তা কেউ বলছেন না। বিদেশে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বললেন, এই সরকার পাঁচ বছরের বেশি বা কম থাকতে পারে। সাথে সাথে দেশে সমালোচনা শুরু হয়ে গেল। কেউ বললেন, ইউনূস সাহেব এটি বলার অধিকার রাখেন না। কেউ বললেন, তিনি অপ্রয়োজনীয় কথা বলেছেন। ৮ ডিসেম্বর এক উপদেষ্টা বললেন, আগামী বছরে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু ইউনূস সাহেব চুপ করে রইলেন। তার উপদেষ্টা ইউনূস সাহেবের অনুমতি ব্যতীত কিছু বলতে পারেন না, এটি সত্য কথা। শিক্ষা উপদেষ্টার কথাটি গত ৮ ডিসেম্বরের। এরপর দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা কক্সবাজারের সালাহ উদ্দীন আহমদ বললেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তিন বা চার মাসের বেশি সময় লাগার কথা না। বিএনপি নেতারা এর আগে বলেছিলেন, ইউনূস সাহেব পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলেছেন। তারা আরো বলেছিলেন, ‘আগে নির্বাচন চাই, পরে সংস্কার।’ এর মধ্যে উঠতি নেতা ও সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বললেন, এ সরকার ব্যর্থ। বিএনপি নেতারা চুপ মেরে রইলেন এ ব্যাপারে; বরং তারা বর্তমান সরকারকে সফল করতে উৎসাহী বলে প্রতীয়মান হয়। তারা এ সরকারকে ‘যৌক্তিক’ সময় দিতে প্রস্তুত। ফলে তারা রাষ্ট্রপতি ও কোনো কোনো উপদেষ্টা নিয়ে উচ্চবাচ্য করছেন না। বিএনপি নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে এমনিতেই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আর জটিলতা বাড়িয়ে লাভ নেই।
শেখ হাসিনা ভারতে যতই ব্যস্ত থাকুক, তাতে কাজ হবে না। হাসিনা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যতই আগ্রহ দেখান না কেন, লাভ নেই তাতে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন; জনমনের আগ্রহই ছিল ওই দিকে। এখন রাষ্ট্রপতি তা অস্বীকার করলে কী হবে? হাসিনা পদত্যাগ করার পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। জনগণের আগ্রহ এই দু’দিকে।
৫ আগস্টের পটভূমি পরিবর্তনের পরে সবাই মনে করেছিলেন, ক্ষমতার তিন কেন্দ্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব হবে, তা হয়নি। মাঝে মধ্যে যদিও হওয়ার উপক্রম হয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে এবং সংস্কার বনাম নির্বাচন নিয়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিপক্ষ মনে হয় ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপিকে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাশ টেনে ধরেছে। আর বিএনপির প্রতিপক্ষ মনে হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিপক্ষ মনে হয়েছে বিএনপি ও সরকারকে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও গণতান্ত্রিক অধিকার পরিষদের মতো উঠতি সংগঠনগুলো অনেক ক্ষেত্রে উগ্রতা প্রদর্শন করেছে। কিন্তু বিএনপি ও সরকার ধৈর্য ধারণ করায় ওদের সব প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে যায়। সংস্কার ও নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া কিন্তু নির্বাচন যথাসময়ে হতে হবে। নির্বাচনের জন্য সংস্কার ঠেকে থাকবে না, আবার সংস্কারের জন্য নির্বাচন বসে থাকবে না। মাঝে মধ্যে বিএনপি সন্দেহ পোষণ করেছে সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। বলেছে, সরকার নির্বাচনের চাইতে সংস্কারে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে এবং এই সুযোগে ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু তারা মাত্রাছাড়া কথা বলেননি। বৃহত্তম মিত্র জামায়াতে ইসলামীও অনুরূপ মনোভাব পোষণ করে। ফলে প্রেসিডেন্ট এবং কোনো কোনো উপদেষ্টাকে নিয়ে অপ্রীতিকর সমস্যার উদ্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি। মোট কথা, আমাদেরকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক থাকতে হবে; নয়তো তারা সুযোগ পাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়ার। ফ্যাসিস্টদের দোসররা এখনো সরকারের মধ্যে লুক্কায়িত আছে। এদেরকে চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। শুধু প্রভাব বৃদ্ধির কথা বলে লাভ নেই, সুশাসনও কায়েম করতে হবে। ভারতে বসে শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্র করছেন, শুধু এ কথা বলে লাভ নেই। এদের বিরুদ্ধে এক হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং আন্দোলন জোরদার করতে হবে। অন্যথায় দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ পাবে। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ জারি রাখতে হবে। ওরা যাতে মাথা তুলতে না পারে, সেই প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। সর্বপ্রকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে।
নব্য ফ্যাসিস্টরা সুষ্ঠু নির্বাচনকে ধ্বংস করেছে যে নির্বাচন গণতন্ত্রভিত্তিক। তারা জাতিকে উপহার দিয়েছে ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের নৈশনির্বাচন এবং ২০২২ সালের প্রহসনের নির্বাচন। তাদের আমলে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, স্বাধীন, সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তারা দলীয়করণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। নিরপেক্ষতা তাদের ছিল না। তারা বিশেষ পরিবারের কর্তৃত্বের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়েছে। তারা জনগণের টুঁটি চেপে ধরেছিল। তারা, এক কথায় গণতন্ত্রের শত্রু। তাদেরকে আর কোনো দিন ক্ষমতায় যেতে দেয়া যায় না।