Image description

দেশের ৯৯ শতাংশ পরিবারে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ফোন, বিভিন্ন সময়ে এমন তথ্য সামনে এসেছে। প্রতিদিনই এর ব্যবহারকারী বৃদ্ধির পাওয়ায় ক্রমেই বড় হচ্ছে যন্ত্রাংশের বাজার। রাজধানীর গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, হল মার্কেট ও পাতাল মার্কেটের ব্যবসায়ীরাই মূলত এ ধরনের পণ্য আমদানি ও পাইকারি বিক্রি করেন। দেশে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বাজারে এসব পণ্যের প্রধান উৎস চীন। তাদের উৎপাদিত যন্ত্রাংশ বাংলাদেশের মার্কেটে একচেটিয়া ব্যবসা করছে।

জানা গেছে, চীন থেকে আমদানি করা মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশের মধ্যে ডিসপ্লে, ব্যাটারি, মাদারবোর্ড, ক্যামেরা মডিউল, চার্জিং পোর্ট, স্পিকার, ভাইব্রেশন মোটর, রেবন, ব্লুটুথ ইয়ারফোন, কভার, পাওয়ার ব্যাংকসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে। কিছু ডিসপ্লে ভারত থেকে আসে, কিন্তু  সেগুলোও চীনা পণ্য। 

ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করে আংশিক প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেজিংয়ের পর বাংলাদেশে রপ্তানি করে। ফলে উৎসের দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের মোবাইল যন্ত্রাংশ বাজারের প্রায় শতভাগই কোনো না কোনোভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। এসব পণ্য দেশে উৎপাদনের বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ কনটেইনার মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে আসে। প্রতিটিতে গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার পণ্য থাকে। এ হিসাবে সপ্তাহে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ আমদানি হচ্ছে। বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়। 

মোবাইল যন্ত্রাংশের আমদানির পরিমাণ, অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পখাতের চেয়ে বেশি। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এসব যন্ত্রাংশ বিক্রি হয় তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে। সে হিসেবে এসব পণ্যের বাজার ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ কনটেইনার মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে আসে। প্রতিটিতে গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার পণ্য থাকে। এ হিসাবে সপ্তাহে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ আমদানি হচ্ছে। বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়। 

দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারী বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে মোবাইল ফোন মেরামতের দোকানও। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যন্ত্রাংশের চাহিদা বহুগুণে বেড়েছে। ভাঙা স্ক্রিন, ব্যাটারি বা অন্যান্য যন্ত্রাংশ বদলাতে দেশের অসংখ্য মোবাইল সার্ভিসিং দোকান নির্ভর করছে এসব আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের ওপর।

আমদানিকারকরা বলছেন, চীন শুধু যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী নয়, বরং পুরো গ্লোবাল মোবাইল সাপ্লাই চেইনের কেন্দ্র। ফলে তারা সব ধরনের ফোনের যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে। দেশটিতে উৎপাদিত যন্ত্রাংশের দাম যেমন তুলনামূলক কম, তেমন সরবরাহও দ্রুত। 

মোবাইল যন্ত্রাংশ আমদানিকারক মোতালেব মিয়া দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্রায় সব জনপ্রিয় স্মার্টফোন ব্র্যান্ডের যন্ত্রাংশ চীনের বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। এ কারণে আমদানিকারকরা বিকল্প উৎসে যাওয়ার আগ্রহ কম দেখান। তবে বিকল্প দেশ থেকে আমদানি বা দেশেই যদি উৎপাদন করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে বাজারে বৈচিত্র্য আসবে।’

এদিকে ভিয়েতনামকে মোবাইল যন্ত্রাংশের সম্ভাবনাময় বিকল্প উৎস হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। দেশটি ইতোমধ্যে বৈশ্বিক ইলেকট্রনিক্স ও স্মার্টফোন উৎপাদনের একটি বড় হাব হয়ে উঠেছে। স্যামসাংসহ একাধিক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বড় উৎপাদন কেন্দ্রও ভিয়েতনাম। 

আমদানিকারক ও বাংলাদেশ সেলুলার ফোন অ্যাক্সেসরিজ ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আব্দুর রহিম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ভিয়েতনামের যন্ত্রাংশের দাম চীনের তুলনায় কম, আবার গুণগত মানও আন্তর্জাতিক মানের। বিশেষ করে ডিসপ্লে, ব্যাটারি ও নির্দিষ্ট কিছু ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টে ভিয়েতনামের সক্ষমতা বাড়ছে।’

ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশে যন্ত্রাংশ আমদানি করা সহজ না হওয়ায় চীনের ওপর আমদানিকারকরা নির্ভরশীল বলে জানান এ ব্যবসায়ী নেতা। আব্দুর রহমান বলেন, ‘ভিয়েতনামে তৈরি পণ্যের দাম কম এবং গুণগত মান অনেক ভালো। তবে সেখান থেকে আমদানি করতে কিছু জটিলতা রয়েছে। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি না থাকাটা একটা বাধা। এলসি খুলতেও ভোগান্তি আছে। ফলে অনেক ব্যবসায়ী আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ভিয়েতনামমুখী হতে পারছেন না।’

বাজারে উন্নত মানের যন্ত্রাংশ সরবরাহে কাজ চলছে জানিয়ে বাংলাদেশ সেলুলার ফোন অ্যাক্সেসরিজ ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ নিয়াজ মোর্শেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা সংগঠনের মাধ্যমে ভালো মানের পণ্য সরবরাহের চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে চীনের মার্কেট থেকে আমরা বেশি মালামাল আমদানি করি।’

তিনি বলেন, ‘দেশে এ ধরনের পণ্যের চাহিদা এখন বাড়ছে। ভবিষ্যতেও এ শিল্পের পরিসর বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দেশে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন শুরু হলে বাজারের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতি সমৃদ্ধি হবে।’

এমন ক্রমবর্ধমান বড় শিল্পের জন্য এক দেশের ওপর নির্ভর করা ভালো নয় মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি এই বাজারটার কথা চিন্তা করি, খুচরা যন্ত্রপাতি বাজার এককভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। তবে তারা অনেক ধরনের জিনিস তাদের দেশে উৎপাদন করে না। প্রকৃতপক্ষে আউটসোর্সিং করে বিভিন্ন দেশ থেকে উৎপাদন করে পরে চীনের পণ্য হিসেবে রপ্তানি করে।’

তিনি মনে করেন, চীনের থেকে বাংলাদেশে বেশি পণ্য আসা বা বাংলাদেশ এককভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণ হচ্ছে দেশটির সাথে দেশের ব্যবসার সহজীকরণ। ব্যাংক থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেনের যে জায়গাটা, সেটা হচ্ছে সহজীকরণ করা হয়েছে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সেটা এখনো দুর্বল। অতএব সে জায়গা থেকে এটা কাইন্ড অফ মনোপলি এসে শেষ। 

তিনি বলেন, ‘মনোপলি যদি থাকে তাহলে হচ্ছে আপনি চোখ বন্ধ করে বলতে পারেন যে, মনোপলি ডিস্টোরশন ক্রিয়েট করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভোক্তারা প্রকৃতপক্ষে যে দামে এই জিনিসগুলো পেত প্রকৃতপক্ষে তার থেকে অধিক দামে চিন থেকে কিনছে।’ 

‘এখন সেই মনোপলির জায়গায় কমপক্ষে দ্বিপলি বা অলিগোপলি বলি, মার্কেটের ন্যাচারেও যদি আমরা পেতাম, তাহলে প্রকৃতপক্ষে তার থেকেও অনেক সাশ্রয় হতো এবং ভোক্তারা আসলে কম দামে কিনতে পারতো’, যোগ করেন ড. মুহাম্মদ সাহাদাত।

আমদানি কমিয়ে দেশীয় উৎপাদনের ওপর জোর দিয়ে ড. সাহাদাত বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের রাইজিং ও সাস্টেইনেবল- এই দুটো জায়গা থেকে যদি বিবেচনা করেন, তাহলে মোবাইলের মার্কেট তার মধ্যে অন্যতম। এখন প্রতিটি পরিবারেই যেহেতু মোবাইল আছে, প্রাপ্ত বয়স্ক সবার হাতে মোবাইল আছে, অনেকের হাতে ২-৩টাও আছে। সে হিসেবে জনসংখ্যার চেয়েও বেশি মোবাইল ফোন আছে বলা যায়।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের চিন্তা করা উচিত- প্রথমত সেটা হচ্ছে যে, এই খুচরা যন্ত্রপাতি উৎপাদন যদি চীন ও ভিয়েতনাম করতে পারে, বাংলাদেশেরও সেই সক্ষমতা আছে। কিন্তু সেটা কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, সেখানে বাংলাদেশের দুর্বলতা রয়েছে। সরকারের উদ্যোগের অভাব এবং যারা এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সরাসরি কিনে বিক্রি করার চিন্তা, এ শিল্প গড়ে না ওঠার অন্যতম কারণ। এ ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত কিন্তু উৎপাদন করে উদ্যোক্তা হতে পারেন। 

অল্প মাত্রায় উৎপাদন শুরু করতে পারলেও দীর্ঘ মেয়াদে বড় সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ সাহাদাত বলেন, ‘মার্কেটটা অনেক বড় এবং পণ্যের চাহিদা কমবে না। কারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। সারাজীবন এর চাহিদা থাকবে, ফলে জায়গা থেকে টেকসই ব্যবসার দিক থেকে বিবেচনা করা হলে, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের এই শিল্প গড়ে তুলতে এগিয়ে আসা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘এই শিল্প গড়ে তুলতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বড় অবদান রাখা সম্ভব। আমরা আমদানি না করে যদি দেশীয় পণ্য উৎপাদন করি, তাহলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। অর্থনীতিতে এ অর্থ যোগ হবে, যা প্রকৃতপক্ষে জিডিপিতে অবদান রাখবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল যন্ত্রাংশের বাজারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- অনানুষ্ঠানিক বা গ্রে মার্কেট। সরকারি হিসাবের বাইরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ যন্ত্রাংশ দেশে প্রবেশ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে একদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, অন্যদিকে মানহীন পণ্যের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দেশে উৎপাদন বাড়লে এবং আমদানি প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ হলে এই মার্কেট নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।