ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে বাসমতি পাউডার ফ্লেভার নামে সেন্ট, যা চিকন আতপ চালে (পোলাওয়ের চালে) মিশিয়ে ৮০ টাকা কেজির খাদ্যপণ্যটি বিক্রি করা হচ্ছে ১৫০ টাকায়। এতে পোলাওয়ের চাল হিসেবে কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।
চালে সুগন্ধি পাউডার মিশিয়ে বিক্রির প্রচলন ভারতে পুরোনো হলেও এখন বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এভাবেই সাধারণ মানুষকে পোলাওয়ের নামে আতপ চাল খাওয়াচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ধান-চাল উৎপাদনে নওগাঁ জেলা অন্যতম। এখানে উৎপাদন হয় তিন জাতের চিকন ধান, যার মাত্র একটিতে সুগন্ধ থাকে, অপর দুটি সাধারণ। এ সুযোগে কিছু চালকল মালিক ছাঁটাইয়ের সময় এক জাতের চালে সুগন্ধি পাউডার মিশিয়ে সেটিকে বিশেষ করে তোলেন। ওই পাউডার আসছে ভারত থেকে চোরাই পথে, যার নাম ‘বাসমতি পাউডার ফ্লেভার’। এটা তৈরি হয় ভারতের নয়াদিল্লির বদলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায়। এ পাউডার উৎপাদক কোম্পানির নাম ‘জগন ইন্ডাস্ট্রিজ’। শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি নিজেই এটি বাজারজাত করে।
এর আগে দেখা গেছে, ভারত থেকে অসৎ ব্যবসায়ীরা ডাল-চালে মেশানোর জন্য অবিকল একই আকারের ক্ষুদ্র পাথর আমাদের দেশে আনত। এর নাম ছিল চালের পাথর, মসুর ডালের পাথর, কলাইয়ের পাথর ইত্যাদি। এবার আমাদের আতপ চালের ঐতিহ্য নষ্ট করতে চোরাই পথে আসছে সুগন্ধি পাউডার। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার লোভে দেশবাসীকে ঠকাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এ কারণে গন্ধ দেখে পোলাওয়ের চাল কিনে এনে ধোয়ার পর আর গন্ধ পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারাও এ ধরনের অভিযোগ পেয়েছেন। কোনো কোনো চালকলের পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাপক সুগন্ধ পাওয়া যায়, স্বাভাবিকভাবে যা হওয়ার কথা নয়। নওগাঁ উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার। এখানে অন্যান্য চালের পাশাপাশি পোলাওয়ের চাল বলে পরিচিত আতপ চাল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়।
২০২৪ সালে আমন মৌসুমে নওগাঁয় বিআর-৯০, বিআর-৩৪ ও স্থানীয় জাতের আতপ চাল মোট এক লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ টন উৎপাদন হয়। চলতি মৌসুমের আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। ফসল ভালো হওয়ায় এবার আতপ চাল এক লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন উৎপাদন হবে বলে কৃষি বিভাগ আশা করছে। আমন ধানের বেশিরভাগই মিল মালিকরা কিনে গুদামজাত করে এবং পর্যায়ক্রমে তা ভাঙিয়ে বাজারজাত করেন।
নওগাঁ শহরের বড় চাল বাজারের ব্যবসায়ী আবদুস ছামাদ ও মহাদেব ঘোষ বলেন, বর্তমানে চিনি আতপ চাল নামে যে খাদ্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেটি গত বছরের। নতুন চাল এখনো নামেনি। চালে সুগন্ধি মেশানো হয় কি না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, মিল মালিকরা কী করে, তা আমাদের জানার কথা নয়। তবে মাঝে মাঝে গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়, চাল ধোয়ার পর গন্ধ থাকে না। বর্তমানে বাজারে খোলা চিনি আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেটজাত চাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে।
নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হুমায়রা মণ্ডলের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, একমাত্র বিআর-৩৪ জাতের চালে গন্ধ আছে। বিআর-৯০ ও স্থানীয় জাতের (গোল্ডেন) চালে গন্ধ নেই। তিন জাতের চাল দেখতে প্রায় একই রকম। এ কারণে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে বিআর-৩৪ জাতের সঙ্গে অন্য চাল মিশিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বলেন, বাসমতি পাউডার মিশিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করার বিষয়টি তার নজরে এসেছে। চালে মেশানো গন্ধযুক্ত পাউডারের নমুনা তারা সংগ্রহ করেছেন। পাউডারটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক কি না, সেটিসহ অন্যান্য বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। গন্ধ মিশিয়ে ৮০-৯০ টাকার চাল ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করাটা অন্যায়।
তিনি জানান, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ, এ চাল মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ব্যবহার করা অন্যায়।
নওগাঁ জেলা অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলামের কাছে আতপ চালে সুগন্ধি মেশানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমি এ কথা শুনেছি। তবে আমার বিশ্বাস, কোনো ভালো ব্যবসায়ীর এ কাজ করার কথা নয়। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী এটা করতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর জন্য প্রকৃত ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
খাদ্যশস্যে ভেজাল মেশানোয় পারদর্শী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চালে সুগন্ধি মেশানোর কাজটি তারা আগে থেকেই করছে। দেশটির অনেক কারখানায় এ পাউডার তৈরি হয়।
বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জানা যায়, ভারতের ইন্ডিয়ান টাইমস পত্রিকায় ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ সংখ্যায় সুধাকর রেড্ডির লেখা একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সুগন্ধ থাকে না এমন কম দামি চালে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি মিশিয়ে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।