
এক মাস ধরে বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ একেবারে নেই বললেই চলে। ভোক্তারা বাধ্য হচ্ছেন সয়াবিনের বিকল্প তেল খুঁজতে। এতে ক্রেতাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ডিলাররা বলছেন মিলমালিকরা দাম বাড়াতে চায় বলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। তবে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সয়াবিন তেলের সংকটের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে এস আলম ও বসুন্ধরা গ্রুপ।
গত ১০ ডিসেম্বর ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে লিটারে আট টাকা বাড়ানোর পর কয়েকদিন সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পর ফের বাজারে বোতলজাত ভোজ্যতেলের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে।
ডিলাররা বলছেন সব প্রতিষ্ঠান সয়াবিন তেল সরবরাহ না করায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। কয়েকটি ডিলারের দোকান বন্ধও দেখা যায় কারওয়ান বাজারে। ভোক্তারা বলছেন সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে রমজানে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।
আজমিরা খাতুন নামে এক ভোক্তা বলেন, বাজারে সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া মানে সোনার হরিণ খুঁজে পাওয়া। কয়েকটি দোকান ঘুরেও সয়াবিন তেলের বোতল পাইনি। বুঝতেই পারছেন সয়াবিনের সংকট কতটা প্রকট।
ভোগ্যপণ্যের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ মুহূর্তে বাজারে সয়াবিনের সংকট কৃত্রিম। খোঁজ নিয়ে দেখেন কেন সয়াবিন তেলের সংকট কাটছে না, এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন এস আলম ও বসুন্ধরা গ্রুপ। তারা এর আগে ৬০-৭০ শতাংশ ভোজ্যতেলসহ ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। এ দুটি কোম্পানির তেলের মিল বন্ধ রয়েছে। ফলে সংকট তৈরির ক্ষেত্রে এরাই জড়িত। সেহেতু সরকারকে প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নগরীর হাতিরপুল, নয়াবাজার ও কারওয়ান বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল খুব কম সংখ্যক দোকানেই সীমিত আকারে পাওয়া গেলেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্যানোলা তেল ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে। সয়াবিন তেলের পাঁচ লিটারের দাম যেখানে ৮৫০ টাকা, সেখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্যানোলা তেল ৯৪০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ কোম্পানিগুলো ক্যানোলার নামে বেশি দামে সয়াবিন তেল বাজারজাত করে অধিক মুনাফা করছে।
অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ এবং ফুডগ্রেডবিহীন ড্রামে খোলা ভোজ্যতেলে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। আর অনেক নকল বোতলও পাওয়া যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের হাজি মিজান ট্রেডার্সের মালিক মিজানুর রহমান বলেন, যেখানে সপ্তাহে ৫০০ থেকে ৬০০ কার্টন সয়াবিন তেলের দরকার, সেখানে তিনদিন পরপর পাওয়া যাচ্ছে মাত্র পাঁচ থেকে ১০ কার্টন তেল। তার মতে, বাজারে বড় ধরনের সিন্ডিকেট সক্রিয়। এ বিষয়ে সরকারের শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
মেসার্স আল-আমিন টেডার্সের আজগর হোসেন বলেন, সয়াবিন তেল তো পাওয়াই যাচ্ছে না। বিক্রি করব কোথা থেকে? ১০০ কার্টন চাইলে পাঁচ কার্টনও পাওয়া যাচ্ছে না।
কারওয়ান বাজার থেকে নাদিরা আক্তার পাঁচ লিটারের বোতলে করে খোলা ভোজ্যতেল নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না, তাই খোলা তেল কিনেছি। সাত-আটজনের সংসারে তেল একটু বেশি লাগে, কিন্তু ক্যানোলা তেল কিনার মতো সাধ্য নেই। ফলে বাধ্য হয়েই খোলা তেল কিনতে হচ্ছে।
মিরপুর কালসী এলাকার বাসিন্দা শাহ নেওয়াজ বলেন, সয়াবিন তেল দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও তা ক্যানোলা বলে বেশি দাম চাচ্ছে । পাওয়া গেলেও বোতলের গায়ে লেখা দাম ঘষামাজা করে উঠিয়ে বেশি দাম চাচ্ছেন দোকানিরা।
শুধু ভোজ্যতেলেই কারসাজি করে বাজার থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র। এমনটিই দাবি করেছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, রমজানকে সামনে রেখে বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয় হলেও সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বরং বাণিজ্য উপদেষ্টার বক্তব্য ও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ভুমিকারও সমালোচনা করেন।
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে আদা ও আলুসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে। তরিতরকারির দাম খানিকটা ঊর্ধ্বমুখী। বাজার মনিটরিংয়ে এখনো চোখে পড়ার মতো সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
চালের দাম নতুন করে না বাড়লেও আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। রাইস এজেন্সির ওসমান গণি বলেন, কিছুদিন আগে সরু জাতের চাল কেজি প্রতি সাত-আট টাকা বেড়েছিল, সেই বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবে কোনো কোনো কোম্পানি ৫০ থেকে ৭০ টাকা বস্তাপ্রতি কমালেও খুচরা বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই।
বাজারে আদা কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পাইকারি বাজারে আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে আলু কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা বেড়ে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শাকসবজিসহ অন্য কাঁচা পণ্যের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।