
রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দলমত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে বৈষম্যহীনভাবে সেবা প্রদান করা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রশাসন ও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দেখা গেছে দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করতে তথা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতাও ছিল- কে কার চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে চরম জালিয়াতি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার সুযোগ পায় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রশাসন ও পুলিশের এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তালিকা হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেককে ওএসডি করা হয়েছে, কাউকে কাউকে পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে। এখানেই শেষ নয়। সূত্রের খবর, কতিপয় কর্মকর্তাকে প্রয়োজনে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে। সব মিলিয়ে আওয়ামী স্বার্থে কাজ করা এসব কর্মকর্তার মধ্যে এখন রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে দলীয় স্বার্থে কাজ করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) দায়িত্ব পালনকারী ২২ কর্মকর্তাকে গত বৃহস্পতিবার অবসরে পাঠানো হয়েছে। ২৫ বছর চাকরির মেয়াদ পূরণ হয়নি এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে দুই দফায় ৩৩ ও ১২ জনকে ইতোমধ্যে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। আরও অনেকেই আতঙ্কে আছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার শঙ্কায়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন যারা, তাদের ওএসডি করার পাশাপাশি অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে।
গতকাল শুক্রবার নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া লিখেছেন, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে ৬৪ জেলার দায়িত্বে থাকা এসপিদেরও ওএসডি/বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে।
শেখ হাসিনার আমলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তী সময় ডিসি হওয়া কর্মকর্তারা শাস্তির প্রাথমিক তালিকায় রয়েছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে
দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারাও আছেন শাস্তি আতঙ্কে। তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার আতঙ্কেও ভুগছেন। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হতে ভূমিকা রাখা কর্মকর্তাদের শাস্তি প্রদানের অভিমত এসেছে সংশ্লিষ্ট সব মহল থেকেই। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের প্রথম দিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী পিএস ও এপিএস নিয়োগ দেওয়া হতো। পরে অবশ্য পিএস নিয়োগ দেওয়া হতো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অজান্তে। যদিও তাদের একটা বড় অংশ পরবর্তী সময় জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেখা গেছে, ডিসি নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। সবাইকে নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংস্থার গোপন প্রতিবেদন ও দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আবার এটাও ঠিক, রিটার্নিং অফিসার মাত্রই যে ভোট ডাকাতি করেছেন, তা কিন্তু নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী প্রিসাইডিং, পোলিং কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীসহ সাত লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। তখন গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের মাধ্যমে ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী যাচাই-বাছাই করা হয়। বর্তমানে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ জড়িত কর্মকর্তাদের ব্যাপারেই আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে সরাসরি শতভাগ অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল একটি চক্র যারা ‘অর্থবাণিজ্য’ও করেছেন। এর বাইরে কিছু লোক আছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায় এড়াতে পারেন না। কারচুপি এড়াতে তাদের চেষ্টা আদৌ ছিল কিনা, তাও খতিয়ে দেখার কথা বলা হচ্ছে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের মধ্যে বেশি আলোচনায় রাতের ভোট হিসেবে খ্যাত ২০১৮ সালের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অনেক কর্মকর্তাই সরকারি কর্মচারী হয়েও দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করতেন। অতীতে করা ছাত্র সংগঠনের নামও তারা সদর্পে উল্লেখ করতেন। তাদের কারণে ক্ষেত্রবিশেষে দলীয় নেতাকর্মীরাও কোণঠাসা ছিলেন। ফলে জনগণের ভোটের চেয়ে কর্মকর্তাদের তুষ্ট রাখা গুরুত্ব পেয়েছে তৎকালীন সরকারপ্রধানের কাছে। এ জন্য কর্মকর্তারা যখন-তখন স্বপ্রণোদিত হয়ে টুঙ্গিপাড়া সফরকে রাষ্ট্রীয় কাজ হিসেবে তুলে ধরতেন। পদোন্নতি ও বদলি, বিশেষ করে ডিসি-এসপির ফিটলিস্টে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দলীয় পরিচয় যুক্ত করতেন বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল। সেগুলোর রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, এসপি, ওসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা খতিয়ে দেখার দাবি জোরালো হচ্ছে। কারণ ওই সময় অন্তত ৫৮৬ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নৌকা শতভাগ ভোট পায়। ধানের শীষ ১ হাজার ২৮৫ কেন্দ্রে একটি ভোটও পায়নি। গণ-অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনে পুলিশ ও ডিসিরা একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েছেন। বলে রাখা ভালো, ওই সময়ের নির্বাচন নিয়ে ৮০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং এসব কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার নগ্ন দৃষ্টান্তও ছিল অসংখ্য। ২০১৮ সালের নির্বাচনের বছরে ৩৪৯ জনকে বিপিএম-পিপিএম দেওয়া হয়েছিল। দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জ ডিআইজিসহ ইউনিটপ্রধানরা পদক পেয়েছিলেন। এর আগে ৬৪ জেলার এসপিসহ সব ইউনিটপ্রধানের একসঙ্গে পদক পাওয়ার নজির নেই। বেশিরভাগ কর্মকর্তা নির্বাচনে ‘বিশেষ ভূমিকা’ রাখার পুরস্কার হিসেবে এসব পদক পেয়েছেন। নির্বাচনের আগে-পরে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে দমনপীড়নের স্বীকৃতিও ছিল এসব পদক। তবে ২০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের বছরে পুলিশের ১০৩ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দেওয়া বিপিএম-পিপিএম প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। তখন রিটার্নিং অফিসারে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারাও পেয়েছিলেন প্রাইজ পোস্টিং। তাদের অনেকে এখন ওএসডি অথবা ‘জনস্বার্থে’ বাধ্যতামূলক অবসরের খবর পাচ্ছেন।
সূত্রমতে, নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুলিশ সদর দপ্তর, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক, ইউএনও এমনকি নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের ভূমিকা কী ছিল তাও খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। শুধু ডিসি-এসপি নয়, গুরুত্ব পাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার কার্যক্রম খতিয়ে দেখে দায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি। কেবল ডিসিদের শাস্তি হলে অনুজ কর্মকর্তারা কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন, এমন শঙ্কাও রয়েছে।
তবে সদ্য সমাপ্ত ডিসি সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, এবারের নির্বাচনে ডিসিরা নির্ভয়ে এবং নির্ভারভাবে কাজ করতে পারবেন। কারণ নির্বাচনের ফলাফলকে কোনো দলের পক্ষে প্রভাবিত করার সুযোগ তাদের নেই।
স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতকরণে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করেন। এসব সহায়তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভয়ভীতিহীন পরিবেশে নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা, প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা হতে হয় রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনামলে দেখা গেছে, তাদের কর্মকা- ও বক্তব্য দুটোই দলীয় কর্মীর মতো। আগের রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরা হতো। ২০১৮ সালে রাতের বেলায় বাক্স ভরার অভিযোগে নির্বাচনের দিন সকাল বেলায় শতাধিক আসনে ভোট বর্জন করেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। অস্বাভাবিক ফলাফলের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে দেখানো হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি সাকল্যে পায় মাত্র ৬টি আসন। আওয়ামী লীগ ২৫৮ এবং জাতীয় পার্টি ২২ আসন পায়। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায় ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত অবস্থান হচ্ছে- যেসব কর্মকর্তা চাকরিবিধি ও আইন লঙ্ঘন করে ভোট কারচুপিতে জড়িত ছিলেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া। এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নির্বাচনে যারপরনাই কারচুপি হয়েছে। তখন দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক দলগুলো। পতিত শেখ হাসিনা সরকার তা পাত্তাই নেয়নি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেরাই ক্ষমতায় আসীন থাকে।