Image description

গর্ত থেকে গলা বের করছে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। দলটির প্রধান ও ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ৬ মাসের মাথায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় থেকে প্রথম রাজনৈতির কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তারা।

হরতাল-অবরোধসহ চলতি ফেব্রুয়ারিজুড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে দেশ শাসনের নামে গুম-খুন-অত্যাচার-নির্যাতন ও লুটপাটে লিপ্ত দলটি। জনগণের ‘সমর্থন’ পেতে পেশাজীবী, সরকারি কর্মচারী, সমর্থকসহ দলের অপেক্ষাকৃত কম দোষী টাইপের লোকদের সামনে রেখে লিফলেট বিতরণ করছে।

সরকারের তরফ থেকেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি দমনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বেশকিছু রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার কথা বলেছে। এদিকে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে প্রতিহত করার ঘোষণা না দিলেও বিএনপিও ভোটের দাবিতে চলতি মাসে আন্দোলনের কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দলের সব নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যায়। পরে দলের বেশ কয়েকজন নেতাও পালিয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে অবস্থান করছেন। বেশ কয়েকজন নেতা ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিরা এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সাংগঠনিকভাবে রীতিমতো বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা ছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে জনগণের বিভিন্ন দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে ছদ্মবেশে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিনিয়তই সরকারি চাকরিজীবী, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার জনগণ তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য রাজপথে নেমেছে।

সরকার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব দাবি আদায়ের আন্দোলনের প্রায় প্রতিটির পেছনে পতিত সরকারের ইন্ধন ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দুই সপ্তাহের মাথায় আনসার বাহিনীর সদস্যরা সচিবালয়ের মতো কেপিআই-য়ে গেট ভেঙে ঢুকে পড়েছিল। যেখানে স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগ সহযোগী সংগঠনের পদধারীদের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়।

তাদের কয়েকজনকে আইনের আওতায়ও আনা হয়। সর্বশেষ তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের যে আন্দোলন করছে সেখানেও আওয়ামী লীগের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল নিজ দপ্তরে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, তিতুমীর কলেজের আন্দোলনে পেছনে ইন্ধন আছে। তিনি গণমাধ্যমকে বিষয়টি খোঁজ নেওয়ার আহ্বান জানান।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ছাত্রদল ও ছাত্র শিবির এবং জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে মতপার্থক্যের জের ধরে দৃশ্যমান বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধকেও আওয়ামী লীগ মাঠে নামার একটি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চাচ্ছে বলে দলটির সূত্র জানিয়েছে।

এছাড়া রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ আইনের সংশোধনীর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সফলতা না আসা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তিশালী করতে না পারা, জুলাই ঘোষণাপত্রসহ বেশকিছু ইস্যুতে সরকার শক্ত অবস্থান নিতে না পারার কারণে সাধারণ মানুষের এক ধরনের হতাশা ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ ইউনূস সরকারকে বেশ দুর্বল মনে করে আওয়ামী লীগ মাঠে নামতে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের জন্য চাপ দেওয়ার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ হিসেবে বিবেচনা করছে।

যার কারণে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর ৬ মাস পর দলটি অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। অবশ্য এর আগে দলের সভাপতি দুই-একজন নেতার সঙ্গে টেলিফোন বার্তায় ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালন ও ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস পালনের ডাক দিয়েছিলেন। তবে ছাত্র-জনতা ও বিএনপিসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমর্থিত দলগুলোর প্রতিরোধে সেই কর্মসূচি পালিত হয়নি।

সরকার ও সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সাম্প্রতিক সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গত ২৫ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মুখোমুখি অবস্থান চলমান থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসিত হবে। সবাইকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে একমত হতে হবে।

এদিকে দলের প্রধান শেখ হাসিনাসহ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা বাংলাদেশে অবস্থানরত কর্মী-সমর্থক ও দল সমর্থিত পেশাজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কর্মসূচি দেওয়া হবে এমন আভাস তারা গত বছরের শেষ দিকেই দিয়েছেন বলে বাংলাদেশে অবস্থানরত মধ্যমসারির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা আমার দেশকে জানিয়েছে। তারা এও জানিয়েছেÑ তারা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ ভিডিও/অডিও কলে যুক্ত হয়ে নিয়মিত আপডেট থাকার চেষ্টা করছে।

বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ আটক ও বিদেশে পলাতক এবং অন্য নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থাকাবস্থায় অজ্ঞাত স্থান থেকে আন্দোলনের ডাক রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশের সব সক্রিয় দল একাট্টা হওয়ার কারণে দলটির আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের মাঠে নামাটাকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন তারা। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, বিএনপি-জামায়াত বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের নিজেদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও আওয়ামী লীগ ইস্যুতে তারা এক কাতারেই রয়েছেন। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে হোক বা নিজেদের দাবি আদায়ে হোক— এই রাজনৈতিক শক্তিগুলো সক্রিয় হলে রাজপথে উত্তেজনা তৈরি হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতারা সম্প্রতি কলকাতায় একটি বৈঠকে মিলিত হন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হন সেই বৈঠকে। এছাড়া ভিন্ন দেশে থাকা দলের কিছু নেতাও অনলাইনে যুক্ত ছিলেন। ওই বৈঠকে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে দলকে সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দলটি তার অফিশিয়াল ই-মেইল ও ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডির মাধ্যমে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি ঘোষণা করে। দলটির কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ, ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ কর্মসূচি এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক কঠোর হরতাল।

অবশ্য মাসব্যাপী কর্মসূচির প্রথম দুই দিনে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে বড় ধরনের আওয়াজ তুলতে পারেনি। তবে শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা টুঙ্গিপাড়ায় পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে লিফলেট বিতরণকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সোমবার সংঘর্ষ ও বাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। রোববার পাবনায় পুলিশের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিফলেট বিতরণের প্রথম তিনদিনে ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ছোট ছোট টিমের লিফলেট বিতরণের খবর পাওয়া যায়। এসব টিমে ৫ থেকে ২০ জন করে কর্মীকে অংশ নিতে দেখা যায়। পরিচয় লুকাতে তাদের অনেককে মাস্ক, হেলমেট পরার পাশাপাশি মাফলার ও টুপি পরে মুখ ঢেকে রাখতে দেখা গেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ভোর ও রাতের বেলায় লিফলেট বিলি ও ঝটিকা মিছিল করতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এসব লিফলেট বিতরণ ও ঝটিকা মিছিলের ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণকালে শনিবার রাতে হবিগঞ্জে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক পিপি শামীম আহমেদকে স্থানীয় জনতা গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে লিফলেট বিতরণকালে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে স্থানীয় যুবদলের কর্মীরা আটক করে পুলিশে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত দলের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বিবিসিকে বলেছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলাসহ নানা কারণে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। তার মতে, এই অবৈধ সরকারের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়। তাই মানুষকে রক্ষা করার জন্য, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা এই কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছি। ফলে সাধারণ মানুষই হরতাল-অবরোধ পালন করবে।

এদিকে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি কঠোরহস্তে মোকাবিলার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলটির কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আওয়ামী লীগের পতাকাতলে কেউ যদি ‘অবৈধ বিক্ষোভ’ করার সাহস করে, তবে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো ধরনের প্রচেষ্টাকে সুযোগ দেব না।’

আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে এক কর্মসূচিতে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হরতাল-অবরোধ, লিফলেট বিতরণ করবা, রাস্তায় নাইমা দেখ, দলমত নির্বিশেষে প্রতিহত করা হবে।

এদিকে ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেছেন, ‘নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের হাত থেকে ছাত্র-জনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের। সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে ছাত্র-জনতা জুলাই-আগস্টের মতোই আবারও রাজপথে নেমে ছাত্রলীগকে প্রতিরোধ করবে। আর আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রতিহত করতে পাল্টা কোনো কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা নেই বিএনপির। তবে, চলতি মাসেই তারা ভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হবে। দলটি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে কর্মসূচি দেবে। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ওই বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দিয়েছে। বিএনপি কর্মসূচির দিনক্ষণ ঘোষণা না দিলেও মধ্য ফেব্রুয়ারি পালন করবে বলে আভাস দিয়েছে। অবশ্য, বিএনপির এই কর্মসূচি আওয়ামী লীগের পাল্টা না হলেও একই মাসের এ কর্মসূচিকে পাল্টা হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।

এদিকে ঘোষণা না দিলেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে মাঠে থাকবে জামায়াত। প্রধান তিন রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে এই মাসে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন গত রোববার নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ দল গঠন করব। সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ চলছে। বেশ ভালোভাবেই চলছে দল গঠনের কাজ। ইতোমধ্যে আন্দোলনের অংশীজন ছাত্র-জনতার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। দ্রুতই রাজনৈতিক দল ঘোষণা হবে এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন দল গঠিত হবে।’

আওয়ামী লীগের কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, সরকার প্রকাশ্যে বলেছে গণহত্যার জন্য দায়ী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া এবং জনগণের কাছে ক্ষমা না চাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। এই ইস্যুটির মীমাংসা ছাড়া তারা রাজনীতি করতে গেলে সরকারই তাদের প্রতিহত করবে। সরকার ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। সরকারের এই অবস্থানের সঙ্গে আমরাও একমত।

বিএনপির তরফ থেকে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রতিহত করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বিএনপির প্রতিহত করার দরকার নেই। দেশের সর্বস্তরের জনগণ তাদের এ দেশে ‘অ্যালাউ’ করবে না। জনতাই তাদের প্রতিহত করবে। কারণ জনতা ৫ আগস্ট উৎখাত করে জানিয়ে দিয়েছে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রশ্নে একটি ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাতে রোববার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, যাদের দৃশ্যমান অবস্থান নেই, তাদের আবার কর্মসূচি কিসের? তারা আতঙ্ক তৈরি করার জন্য এসব করছে। এখানে জননিরাপত্তার বিষয় আছে। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সংগঠন।

এরা বিভিন্ন জায়গায় গুপ্ত হামলার চেষ্টা করছে, গুজব ছড়াচ্ছে। এদের অনেকে মামলার আসামি, পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের ব্যানারে, শেখ পরিবার বা চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও গণহত্যাকারীদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। আমরা যারা অভ্যুত্থান করেছি, তারা মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ আমার দেশকে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে কর্মসূচি দিতেই পারে। কর্মসূচি দেওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক কর্মসূচি হলে রাজপথে একটা উত্তেজনা তৈরি হতেই পারে। তবে দেখার বিষয় তাদের এই কর্মসূচিকে দেশের বড় অংশের জনগণ কীভাবে দেখছে। তাদের কর্মসূচিতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমর্থন মিললে এক ধরনের বার্তা পাওয়া যাবে। না হলে ভিন্ন বার্তা আসবে। জনগণ এটাকে ইতিবাচক না নেতিবাচকভাবে নেয় সেটা তাদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, মোটা দাগে বলতে পারি আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এখনো নিষিদ্ধ নয়। কাজেই তাদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো বাধা থাকার কথা নয়। তবে প্রেক্ষিতটা বুঝতে হবে। যে দল রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে গুম-খুন- অত্যাচার, দুর্নীতি করেছে- দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এর দায় নেওয়ার বিষয় রয়েছে।

কিন্তু গত ৬ মাসে আমরা এখনো কোনো দৃষ্টান্ত দেখিনি তারা এটার জন্য অনুতপ্ত হয়েছে বা নিজেদের দায় স্বীকার করেছে। এজন্য আইনত দলীয়ভাবে কর্মসূচিতে বাধা না থাকলেও নৈতিকতার দিক থেকে তারা কোনো কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যেতে পারে কি না সেটা বিবেচনার বিষয় রয়েছে। তাদের অবাধ কর্মসূচি পালনের স্পেস তৈরি করে দিয়ে জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের অনুভূতিকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

সোমবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বাস্তবে সেভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। প্রপাগান্ডা অনলাইন বেইজ হচ্ছে। তারা ৭০ জায়গায় লিফলেট বিতরণ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ৩/৪টি স্থানে চেষ্টা করা হয়েছে। যারা এটা করার চেষ্টা করেছে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ ধরনের কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলে তা করতে দেওয়া হবে না। স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয় এমন কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। যারা চেষ্টা করবে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।

সরকারি কর্মকর্তার লিফলেট বিতরণ প্রশ্নে তিনি বলেন, তার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সত্যতার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।