Image description

ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে গোয়েন্দাজালে পড়েন মুফতি নাছির উদ্দিন খান। মাহফিল শেষে বাসায় ফেরার পথে গাড়িসহ গুম করে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। চার দিন গুম রেখে ক্রসফায়ারের হুমকিসহ নানাভাবে নির্যাতন শেষে হেফাজতের পুরোনো একটি মামলায় নেওয়া হয় রিমান্ডে। সেখানে মানসিক হয়রানির একপর্যায়ে পাঠানো হয় জেলে। জামিন পেতে গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে রাজনীতি ছাড়াসহ নানা প্রস্তাব দেওয়া হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের এই সহ-সাংগঠনিক সম্পাদককে। পরিবারের সদস্যদেরও নানাভাবে ভয়ভীতি ও চাপ দেয় তারা। এভাবে কোনো কারণ ছাড়াই আওয়ামী সরকারের নিপীড়নের শিকার হয়ে পৌনে চার মাস জেলে বন্দি জীবন কাটাতে হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গাজীপুর জেলার এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে।

বিগত সরকারের জুলুম-নির্যাতনের অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষ আলেমদের বেশিরভাগই তখন ছিলেন জেলে। এমনই সময় ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি গাজীপুরের ভবানীপুর বাজারসংলগ্ন একটি মাদরাসায় ওয়াজ মাহফিলে গিয়েছিলেন জবেদা খাতুন দারুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম মুফতি নাছির উদ্দিন খান। ওই মাহফিল ঘিরে দুপুর থেকেই সেখানে গোয়েন্দা নজরদারি ছিল। মাহফিল শেষে তিনজন আলেমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ফিরছিলেন গাজীপুর শহরের বাসায়। কিন্তু ফেরার পথে মাদরাসা রোড থেকে ভবানীপুর ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়েতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার গাড়ি গতিরোধ করে সাদা পোশাকধারী একদল পুলিশ। সাদা মাইক্রো থামিয়ে রাস্তায় চলাচল বন্ধ করা হয়। হর্ন বাজালেও তারা সরেনি। একপর্যায়ে গাড়ি থামাতেই ওই সাদা মাইক্রোবাস থেকে সাত থেকে আটজন নেমে তার গাড়ি ঘিরে ধরে। গ্লাস নামিয়ে তাদের পরিচয় জানতে চাইলে একজন ডিবির মতিঝিল জোনের প্রধান দাবি করেন। তারা তাদের সঙ্গে যেতে বলেন এই আলেমকে। এ সময় তিনি তাদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে তারা তা দেখান। এ সময় তাদের কোমরে রাখা পিস্তল দেখা যাচ্ছিল। সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা তার গাড়িতে উঠে ঢাকার দিকে রওনা করেন। অন্য তিন আলেমকে সেখানেই নামিয়ে দেওয়া হয়।

সামনে-পেছনে ডিবির গাড়ির পাহারায় নিজের গাড়ি চালাচ্ছিলেন মুফতি নাছির উদ্দিন। গাজীপুর পৌঁছে নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি অসুস্থতা অনুভব করে গাড়ি চালাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাকে ডিবির গাড়িতে নিতে বলেন। কিন্তু তারা তাতে রাজি হননি। একপর্যায়ে রাত পৌনে ১২টার সময় টঙ্গী চেরাগ আলীতে হেফাজতে ইসলামের গাজীপুর নেতা মাসুদুর রহমানের মাদরাসায় গাড়িটি রেখে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু তাতেও তারা রাজি না হয়ে রাত সোয়া ১টার দিকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের মতিঝিল জোনাল অফিসে নেওয়া হয় তাকে। গাড়িটি একপাশে ঢুকিয়ে তাকে একটি রুমে বসানো হয়। ডিবির মতিঝিল জোনাল টিমের প্রধান আফছারুজ্জামান তাকে আটক অভিযানে নেতৃত্ব দেন।

ডিবির যে রুমে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে লাঠি, প্লায়ার্স, বৈদ্যুতিক তারসহ নির্যাতনের জিনিসপত্র দেখা যায়। সেখানে তাকে খাবার দিতে চাইলে তিনি তা খাননি। তার এলাকার পরিচিত হিসেবে ডিবিপ্রধান হাফিজ আখতারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সেই সুযোগ দেননি তারা। তাকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে একটি লকআপের দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পাহারায় ছিলেন তিনজন। শীতের সেই রাতে তাকে একটি কম্বলও দেওয়া হয়। তবে তিনি নিরাপত্তা শঙ্কায় কম্বল না নিয়ে নিজের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম না আসায় রাত ৩টার দিকে তিনি অজু করে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন। পরে ফজরের পর কিছুটা ঘুম দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একের পর এক অফিসার এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তারা বলেন, সব আলেম মোবাইল বন্ধ করে পালিয়ে গেলেন, আপনার খুঁটির জোর কোথায়? আপনি আলেমদের মুক্ত করতে আদালতে আদালতে ঘোরার এই সাহস কোথা থেকে পান? স্বাধীনতাযুদ্ধে আপনাদের দলের ভূমিকা কী ছিল?

এ সময় তার মামলার আইও ডিবির এসআই মালেক তাকে তুই-তোকারি করে বলেন, যা মন চায় খেয়ে নে। কাল তোর ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। তোর আল্লাহ তোকে বাঁচায় কি না? নির্যাতনের জন্য ধর্মেন্দু নামের একজন অফিসারকে ডাক দেওয়ার ভয় দেখান তিনি। এর আগে অনেক আলেম-ওলামাকে নির্যাতন করেছেন ধর্মেন্দু। এভাবে ৯ তারিখ পর্যন্ত সেখানে গুম রাখা হয়। এ সময় দফায় দফায় চলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক নির্যাতন। তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় দাঁড় করিয়ে রাখা হতো।

এ সময় পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ হয়নি। পাঁচ মাসের ছোট বাচ্চাকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়েন। তারা গাজীপুর থানা, এসপি অফিস, সিটি পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে সন্ধান চাইলে কোনো সহযোগিতা করেননি। প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের কাছে গেলে তারাও কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।

 

এদিকে ডিবিতে চার দিন গুম রেখে নির্যাতনের পর ৯ জানুয়ারি নেওয়া হয় পল্টন থানায়। সেখানে ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল হেফাজতের ঘটনায় পল্টন থানায় করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় মুফতি নাছির উদ্দিন খানকে। তাকে কোর্টে নিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। কোর্টে আসার আগেই এক ফাঁকে আত্মীয়স্বজনকে খবর দেন তিনি। এ জন্য তাদের অনেকে কোর্টে হাজির ছিলেন। তবে তাদের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলা ও কাপড় নেওয়ার চেষ্টা করলেও সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে আদলতের বিচারকের অনুমতি নিয়ে নিজের অবস্থান-মর্যাদা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। এ সময় গুম-গ্রেপ্তার-নির্যাতন বিষয়ে কথা বলেন মুফতি নাছির উদ্দিন। আদালত তাকে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।

এদিকে আদালত থেকে পুলিশের গাড়িতে ফেরার সময় তাকে দুজনের মাঝখানে বসতে দেন। সামনে ড্রাইভারের পাশে এসআই মালেক এবং পেছনের সিটে আরো দুজন ছিলেন। এ সময় তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হুমকি-ধমকি দেন এসআই মালেক। বিশেষ আদালতে বিচারকের কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার কারণে তিনি রেগে যান। রিমান্ডের এক দিনে নির্যাতনের হুমকি দেন তিনি। এ সময় মুফতি নাছির উদ্দিন তাকে বলেন, ‘আমরা কোনো খুন করে এখানে আসিনি। আমরা রাজবন্দি। আমাদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করতে পারেন না। এ সময় তিনি কোমর থেকে পিস্তল বের করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন।’

ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নিচতলার জানালাবিহীন একটি রুমে ঢোকায় তাকে। সেখানে দিন-রাত কিছু বোঝা যেত না। খাবার দিতে এলে তার কাছে সময় জিজ্ঞাসা করে সে অনুযায়ী নামাজ পড়তেন তিনি। সেখানে এক-দুই মাস ধরে আটক থাকা অনেকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তাদের অনেকের সঙ্গেই পরিবারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে ডিবির রিমান্ডে দুই রাত এক দিন রেখেও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি মুফতি নাছির উদ্দিনকে। সেখান থেকে আদালতের মাধ্যমে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানেই পৌনে চার মাস কাটাতে হয় তাকে। জেলে ২৪ ঘণ্টা লকআপে রাখা হয়। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। খাবার খেতে পারতেন না। কোনো কারারক্ষী তার সঙ্গে কথা বললে তার শাস্তি হতো। মশার কামড়ে তার সারা শরীর জর্জরিত হয়ে যায়।

এ সময় জামিনের জন্য তার বাবা-ভাইয়েরা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তাদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে এনএসআইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। গাজীপুর এনএসআই থেকে সেন্ট্রালে যেতে বলা হয়। ঢাকায় এনএসআইয়ে হেফাজতের ফাইলগুলো দেখতেন কর্নেল মেজবাহ। তার সঙ্গে ছিলেন মোরশেদ আলম ও ডিবির নুরুল আলম মামুন। তখন তারা মুফতি নাছির উদ্দিনকে রাজনীতি না করার অঙ্গীকার দিতে বলেন। তাহলে জামিনের আশ্বাস দেওয়া হয়। অন্যথায় জামিন দেওয়ার কোনো ক্ষমতা কোর্টের নেই।

 

জেলে থাকা অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে কোনো সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না তার। বাইরে থেকে কোনো খাবার পাঠানো যেত না। কেউ সাক্ষাতের চেষ্টা করলে তাদের সঙ্গে জঙ্গি-সন্ত্রাসীর মতো আচরণ করা হতো। দীর্ঘদিন পর মাসে একবার করে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। সে সময় এনএসআইয়ের সেই প্রস্তাবের কথা শুনে তাতে কোনো সাড়া দেননি মুফতি নাছির উদ্দিন। এ জন্য সারাজীবন জেলে থাকতেও প্রস্তুত তিনি। তবে তার সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই তার ছোট ভাই রাজনীতি ছাড়ার বিষয়ে এনএসআইকে আশ্বাস দিলেও একবার শুনানিতে নানা অজুহাতে তার জামিন হয়নি। কয়েকবার শুনানি করেও জামিনে ব্যর্থ হন তিনি। একপর্যায়ে পৌনে চার মাসের মাথায় জজ কোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি।

 

এদিকে কারারুদ্ধ সন্তানের চিন্তায় তার ৭৫ বছর বয়সি বাবা স্ট্রোক করেন। একপর্যায়ে তার মুক্তির পর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু এর দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। নাছির উদ্দিন খান জানান, মুক্তির সময় আবার গ্রেপ্তারের শঙ্কায় ছিলেন তিনি। কারণ এর আগে ২০১২ সালে কিশোরগঞ্জে রাষ্ট্রদ্রোহির অভিযোগে একটি মামলায় তাকে জড়ানো হয়। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজার রায়ের সময় সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে একটি মামলা দেওয়া হয়। অথচ সে সময় তিনি ওমরাহ পালনে সৌদি আরবে ছিলেন। মুক্তির পরও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে ছিলেন তিনি। এমনকি পল্টন থানার মামলায় দীর্ঘদিন হাজিরা দিতে হয়েছে। এখনো সেটি প্রত্যাহার করা হয়নি। বাকিগুলো আগেই শেষ হয়েছে।

 

কারাগারে নানা কষ্টে থাইরয়েডসহ বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হন তিনি। এ জন্য মুক্তির পর হাসপাতালে ভর্তি হন এই আলেম। বেশ কিছুদিন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফেরেন তিনি। এ সময় কোনো কর্মসূচি থাকলেই তাকে ফোন দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করত এনএসআই ও এসবির লোকরা। তার পরিবারের লোকজন বিশেষ করে ছোট ভাই মাওলানা নাছিমকে বেশি হয়রানি করা হয়েছে। একপর্যায়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে।

 

গত ১৬ বছরে প্রায় সময় ওমরায় সৌদি আরবে থাকতেন মুফতি নাছির উদ্দিন। দেশে এসে স্বস্তিতে থাকতে পারতেন না। তার হজ এজেন্সিসহ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তার শ্বশুরকেও নানাভাবে হয়রানি করা হয় গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে। বাড়ির কাছে একটি মাদরাসা বানিয়েও তা চালু করতে দেয়নি স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকরা। সম্প্রতি সেটা চালু করেন তিনি। এভাবে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি।