Image description

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকে আলোচনায় শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল গঠন। কেমন হবে এই দল, কারা থাকছেন নেতৃত্বে এমন প্রশ্ন, আলোচনা জনমনে। নতুন দল কতোটা মানুষের কাছে যেতে পারবে। কতোটা গ্রহণযোগ্য হবে। আসছে নির্বাচনে কেমন হতে পারে এই দলের প্রভাব- এসব খুঁটিনাটিও এখন আলোচনার বিষয়বস্তু। শিক্ষার্থীদের তরফে দল গঠন করা হবে এটি অনেক আগেই পরিষ্কার করা হয়েছিল। সর্বশেষ ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন ছাত্ররা দল গঠন করতে যাচ্ছে এবং এটা দরকার। কারণ ছাত্ররা জীবন দিয়ে  যে অর্জন করেছে তা রক্ষা করতে হবে। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর মানুষের মাঝে নানা ক্ষেত্রে আশা জেগেছে। প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে পরিবর্তনের। রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে। অর্থনীতি সাবলীল হবে। সমাজ জীবন পরিবর্তন হবে। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সেবা ব্যবস্থা গণমুখী হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। দলীয় মোড়ক থেকে বের হয়ে রাষ্ট্র ও সরকার জনমানুষের হয়ে উঠবে- এমন প্রত্যাশা শুরুতে মানুষ যেমনটা পোষণ করতে শুরু করেছিল ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে তা অনেকটা ম্লান হওয়ার মতো অবস্থা। মানুষের আশা-প্রত্যাশা অবশ্য শেষ হয়ে যায়নি। মানুষ এখনো মনে করে পরিবর্তন দরকার। সেই পরিবর্তন আসবেও। কিন্তু কারা, কোন দল এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে নাকি জাতীয় কোনো উদ্যোগ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করবে- এমন জিজ্ঞাসা দিনকে দিন বাড়ছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করে এই ফেব্রুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের নতুন দল রাজনীতির ময়দানে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এটা হতে পারে মধ্য ফেব্রুয়ারির মাঝেই। বলা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের  যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে এই দলটি হবে মূল প্রেসার গ্রুপ। এ ছাড়া আগামী দিনে দেশে রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরির পেছনেও ভূমিকা রাখবে ছাত্রদের এই নতুন দল। অনেকটা মধ্যধারার এই দলে সব শ্রেণি- পেশার প্রতিনিধিত্ব রাখতে চাইছেন উদ্যোক্তারা। অনেকে বলছেন নতুন দলের সামনে এসব লক্ষ্য পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে। কারণ এতদিন বহু দলের মাঝে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগই ঘুরে ফিরে ভোটের মাঠে প্রভাব ধরে রেখেছে। এর বাইরে যেসব দল আবির্ভূত হয়েছে তারা এই দুই দলের সহযোগী হয়েছে। এককভাবে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের মতো তেমন কোনো দলের দেখা মিলেনি। এখনো নির্বাচন কমিশনের খাতায় যেসব দল রয়েছে এই দুই দলের বাইরে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো দল নেই যারা ভোট বা জনমতের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারছে। এমন অবস্থায় নতুন দল গঠনের আলোচনা মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বিপুল আশাবাদী মানুষের জন্য এটা ভালো খবরও বটে। কারণ মানুষ পরিবর্তন চায়, পরিবর্তন চাইছে। দলীয় স্বার্থের রাজনীতির বাইরে মানুষের জন্য রাজনীতির ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পক্ষেই মানুষ রাস্তায় নেমে অকাতরে জীবন দিয়েছে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যাতে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ হয়, এমন একটা স্বপ্ন নিয়ে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। মানুষের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে নতুন দল কতোটা ভূমিকা রাখতে পারে, কতোটা মানুষের দল হয়ে উঠবে সেই জিজ্ঞাসা নিয়ে মানুষ অপেক্ষায় আছে।  

 

রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন দল আসার আগে নানা ধরনের নেতিবাচক আলোচনা থাকে। অনেক পক্ষের আপত্তি, অনুযোগ থাকে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি যে দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে তার ক্ষেত্রে অনেক ব্যতিক্রমও দেখা যাচ্ছে। প্রায় সব রাজনৈতিক দল তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। দল গঠনের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। সাধারণ মানুষও এমন একটা দল গঠনের প্রয়োজন অনুভব করছে। সরকারের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার মনোভাব আছে এই দলের প্রতি। এমন ইতিবাচক আবহে হতে যাওয়া নতুন দল সঙ্গত কারণেই বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে। বিশেষ করে নানা মঞ্চ থেকে আসা লোকজনকে নিয়ে যে বৃহৎ ঐক্য গড়ে উঠেছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে তার কিছুটা হলেও বিচ্যুতি মাঠে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিভেদ-বিভক্তি বাড়ছে। বিদ্যমান দলগুলোর মতো জুলাই-আগস্টে নেতৃত্ব দেয়া প্ল্যাটফরমের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। 
এমন অবস্থার মধ্যে হতে যাওয়া নতুন দলের কোনো নাম এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। বলা হচ্ছে, শুরুতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে পরবর্তীতে কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। ইতিমধ্যে সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে ছাত্র আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফরম জাতীয় নাগরিক কমিটি। নতুন দল ঘোষণার আগে ছাত্ররা যোগাযোগ রক্ষা করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও। উদ্দেশ্য তাদেরকে নতুন দলে ভেড়ানো। এ ছাড়াও বিভিন্ন দলের নেতারা নিজ থেকেও যোগাযোগ করছেন ছাত্রদের সঙ্গে। সমাজে প্রভাব আছে এমন বিশিষ্টজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। 
 

দল ঘোষণাকে সামনে রেখে পর্যায়ক্রমে পদত্যাগ করবেন সরকারে থাকা ছাত্রদের তিন প্রতিনিধি। যাদের একজন নতুন দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে পারেন। জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন সরকারের আইসিটি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা নাহিদ ইসলাম। যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নম্বর সমন্বয়ক ছিলেন। নাহিদের পর উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। যিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে অথবা অক্টোবরের শেষে পদত্যাগ করতে পারেন। তবে পদত্যাগ ইস্যুতে নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেছেন, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। যদি হয় তাহলে আমরা নিজেরাই বলবো। 
 

নতুন দলে পরিচিত একজন রাজনৈতিক মুখকে নিয়ে আসতে চাইছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সে লক্ষ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। গ্রহণযোগ্য এমন কাউকে পাওয়া গেলে দলের নেতৃত্বে আনা হতে পারে তাকে। 
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ছাত্রদের নতুন দলের নাম চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে আগামী সপ্তাহে অনলাইন ও অফলাইনে গণমানুষের মত নেয়া হবে। মানুষের দেয়া নাম ও নিজেদের প্রস্তাবনা থেকে দলের নাম চূড়ান্ত করা হবে। এক্ষেত্রে নতুন দলের নামেও জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রতিফলন রাখতে চান ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ ছাড়া গঠনতন্ত্রের বিষয়টিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করে এটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রেও জুলাই-আগস্টের চেতনাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দল গঠনের আগে দেশব্যাপী নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক কমিটি দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই একাধিক উপজেলা কমিটি গঠন করে দল গোছানোর চেষ্টায় রয়েছেন তারা। কমিটিগুলো নিজ নিজ এলাকায় দল গঠনের বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে হচ্ছে সভা-সমাবেশ। 
 

দল গঠনের মূল প্রক্রিয়ায় উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম, নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন। 
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠন সারজিস আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদও দল গঠন প্রক্রিয়ায় কাজ করছেন। 
 

নতুন দলের বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন ছাত্রদের দল করা দরকার। কারণ, রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো সেই সব ব্যক্তি নিয়ে যাবে, যারা বিগত প্রশাসন ও অন্যান্যের মতো সবকিছুর পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ খুঁজছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়তো তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এটাও একটা বিপদ। কারণ, রাজনীতি শুরু করলে সব ধরনের রাজনীতিবিদ তাদের সঙ্গে মিশে যাবে। তাই আমরা জানি না তারা আমাদের দেশে যে রাজনীতি, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে কি-না। এ ধরনের সুযোগ আছে, যা আমাদের নিতে হবে। তবে ছাত্ররা প্রস্তুত। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা দেশ জুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে। তিনি বলেন, তরুণরা সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে সংস্পর্শ নেই বা নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা নেই। তারা এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার। 
প্রধান উপদেষ্টা নতুন দল নিয়ে যে আশার কথা বলেছেন, নতুন দলের উদ্যোক্তারাও এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, আমরা একটা মধ্যমপন্থি রাজনীতির কথা বলছি। এটাই আমাদের আদর্শ হবে। আমরা বাম-ডান এমন যে বিভাজন আছে সেগুলোতে ঢুকতে চাই না। আমরা বাংলাদেশ প্রশ্নে এক থাকতে চাই। ইসলাম ফোবিয়ার রাজনীতি অথবা উগ্র ইসলামপন্থি বা উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মধ্যেও আমরা নেই।
 

আমরা জনগণের কাছে গিয়ে যে ধারণা পেয়েছি এবং বিভিন্ন জরিপেও একটা নতুন দলের আকাঙ্ক্ষা আছে জনগণের মধ্যে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। তাদেরকে মানুষ দেখেছে। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে জনগণের একটা বিশাল অংশ আছে, যারা নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব দেখতে চায়। সে জায়গা থেকে আমরা মনে করি আমাদের দল গঠিত হলে সেটা জনসমর্থন পাবে। ধীরে ধীরে আমরা একটা বড় দল হতে পারবো। 
 

ওদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দল কী করবে এই প্রশ্নও সামনে এসেছে। বিশেষ করে ছাত্রদের সমর্থনে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকার মধ্যে ছাত্ররা নতুন দল গঠনে সরকারের আনুকূল্য পাবে এবং ক্ষমতার ছায়ায় এটি কিংস পার্টির মতো হতে পারে- এমনটাও কেউ কেউ বলছেন। বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে কিছু দলকে নিয়ে রাজনৈতিক মোর্চাও করতে পারে নতুন দল। এক্ষেত্রে ইসলামপন্থি একটি দলের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। অনেকে বলছেন, সামনে পরিস্থিতি ক্ষণে ক্ষণে বদলাবে। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নতুন দলের অবস্থান কী হবে তা নির্বাচনের আগের পরিস্থিতিই নির্ধারণ করে দেবে।