চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস এলাকায় অবস্থিত নেভি কনভেনশন সেন্টারে ছেলের বিয়ে উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে গতকাল শনিবার রাতে আটক হন আওয়ামী লীগের নেতা ফখরুল আনোয়ার চৌধুরী। এর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই বিয়ের নানা ঘটনা আলোচিত হচ্ছে।
জানা গেছে, অভিজাত নেভি কনভেনশন সেন্টারে ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীর ছেলে সৈয়দ মিনহাজুল আনোয়ারের সঙ্গে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের নাতনি সৈয়দা মাহবুবা হোসনে আরা মনজুরের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। মাহবুবা হোসনে আরা মনজুর আলমের বড় ছেলে নিজামুল আলমের মেয়ে। অপর দিকে বরের বাবা ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীর আরেকটি পরিচয়, তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ারের চাচা। তাঁর ভাই ও খাদিজাতুলের বাবা প্রয়াত রফিকুল আনোয়ার চৌধুরীও সংসদ সদস্য ছিলেন।
চট্টগ্রামের দুই প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরে বর্ণাঢ্য আয়োজনের কমতি ছিল না। তবে কনভেনশন সেন্টারের সামনে জনতার বিক্ষোভ, লাঠিপেটা এরপর ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীর আটকের ঘটনা বিয়ের আনন্দ-উচ্ছ্বাসকে ছাপিয়ে যায়। মূলত বরের গাড়িবহরে সাবেক এক সংসদ সদস্যের গাড়ি থাকার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, বিক্ষোভকারী ও বিয়ের আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার শুরু রাত সাড়ে ১০টায়। খবর ছড়িয়ে পড়ে, নেভি কনভেনশনে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন সাবেক দুই সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুই সংসদ সদস্যের উপস্থিতির খবর শুনে কনভেনশন সেন্টারে জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীরা। রাত পৌনে ১১টায় তাঁরা ঘেরাও করেন কনভেনশন সেন্টার। এ সময় সেখানে হাজির হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এমন পরিস্থিতির খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একের পর এক ভিডিও দিতে থাকেন সেখানে উপস্থিত থাকা লোকজন।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে থাকা তিন থেকে চার তরুণকে লাঠিপেটা করতে থাকেন। এই সময় কিল–ঘুষিও দেন। এতে এক তরুণের পরনের পোশাক ছিঁড়ে যায়। তাঁদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়। মারধরের শিকার ব্যক্তিরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী বলে জানান কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, কনভেনশন সেন্টার এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা জড়ো হয়ে ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’ স্লোগান দিতে থাকেন। এই ভিডিওতে দেখা গেছে, জড়ো হওয়া তরুণেরা কয়েকজনকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে থাকেন। বয়স্ক একজন মেঝেতে বসে পড়েন। এই সময় চারপাশ থেকে স্লোগান দিতে থাকেন লোকজন।
এদিকে মধ্যরাতে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বরের পিতা ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীকে আটক করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা তাঁকে আটক করে পুলিশের কাছে তুলে দেন বলে জানা গেছে। পরে পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বর-কনে গাড়ি করে কনভেনশন সেন্টার ত্যাগ করেন। এর আগে-পরে দাওয়াতে আসা লোকজনও কনভেনশন সেন্টার থেকে চলে যান। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ভোররাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তাঁরা দুই সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ারকে গ্রেপ্তারের দাবি জানাতে থাকেন। তাঁদের দাবি ছিল, এই দুই সাবেক সংসদ সদস্য সেখানে এসেছেন।
যোগাযোগ করা হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নেভি কনভেনশন সেন্টারে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা (সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক) ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীর ছেলের বিয়ে ছিল। সেখানে পতিত আওয়ামী লীগের দুই সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ার সনিও উপস্থিত ছিলেন বলে তাঁদের কাছে খবর আসে। এই খবর তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে জানান তাঁরা। আর নিজেরাও সেখানে ছুটে যান।
রাসেল আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন। জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা স্বাধীনভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, চলাফেরা করবেন, ছাত্র-জনতা তা মেনে নেবেন না। তাই তাঁরা তাঁদের আটকের দাবিতে কনভেনশন সেন্টার ঘেরাও করতে যান। ফখরুল আনোয়ারকে আটক করতে পারলেও অন্য দুজন পালিয়ে যান। তাঁরা ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।
ঘেরাওয়ের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের কর্মীদের ওপর হামলা করেন বলে অভিযোগ সমন্বয়ক রাসেল আহমেদের। তিনি জানান, হামলা ও মারধরে তাঁদের সাত থেকে আটজন আহত হয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও দুই সাবেক সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তারসহ চার দফা দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বিয়েতে দুই সাবেক সংসদ সদস্য থাকার কথা বললেও তা অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও কনের দাদা মোহাম্মদ মনজুর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফখরুল আনোয়ার চৌধুরী যে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তা তাঁদের জানা ছিল না। কিন্তু এটিকে কেন্দ্র করে বিয়েতে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। ছেলেরা এসে খাদিজাতুল ও নজিবুল বশরকে খুঁজেছেন। কিন্তু তাঁরা তো বিয়ের দাওয়াতে আসেননি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনে রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে আসেন। বরের গাড়িবহরে খাদিজাতুলের গাড়ি ছিল। তাঁরা তো এক পরিবারের সদস্য। তাই অনেকেই মনে করেছেন, গাড়িতে খাদিজাতুলও এসেছেন। কিন্তু তিনি (খাদিজাতুল) আসেননি। পরে এ নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। আর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় বরের কাছে নাতনিকে তুলে দেন।
বিয়ের অনুষ্ঠানের ঘটনায় কোনো ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেবেন না বলে জানান মোহাম্মদ মনজুর আলম।