Image description

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্রের’ জন্য দলের প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে বিএনপি। দলটি এখন তাদের প্রস্তাবের ওপর যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর মতামত নেওয়া শুরু করেছে। বিএনপি মিত্র দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রস্তাব চূড়ান্ত করে তা সরকারকে দেবে বলে দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

যদিও এ ধরনের ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা ও এর আইনগত দিক নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিএনপির। কিন্তু দলটির জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির ঐক্য ধরে রাখার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা ঘোষণাপত্রের জন্য প্রস্তাব দিচ্ছেন। বিএনপি তাদের প্রস্তাবে ১৬টি দফা তুলে ধরেছে।

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির তৈরি করা ঘোষণাপত্রের যে খসড়া পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে, এর সঙ্গে বিএনপির প্রস্তাবের পার্থক্য থাকছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ছাত্রদের খসড়ায় কেবল ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের ৩৬ দিনের আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থান প্রাধান্য পেয়েছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানের কথা সেভাবে আসেনি বলে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলোর নেতাদের অনেকে মনে করেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন ও নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাপ্রবাহ এবং শেষ পর্যন্ত গণ–অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানকে প্রাধান্য দিয়েছে বিএনপি তাদের প্রস্তাবে।

শুধু ’২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের মধ্যেই থাকেনি বিএনপি। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন পরিবর্তনও জায়গা পেয়েছে বিএনপির প্রস্তাবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গও তাদের প্রস্তাবে রাখা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে তাঁরা দলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছেন। শরিকদের মতামত পর্যালোচনা করে ঘোষণাপত্রের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।

বিএনপির প্রস্তাবে যা আছে

প্রস্তাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ আছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা। বিগত ১৬ বছর বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ও তাদের ওপর নিপীড়নের কথা এসেছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা জবরদস্তিমূলক শাসন ও একনায়কতন্ত্র চালিয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি ও মাফিয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। বিগত তিনটি বিতর্কিত ও সাজানো সংসদ নির্বাচনের কথা এসেছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি এবং এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন, সেই আন্দোলনে স্বৈরাচারী শাসনের নিপীড়ন, গণহত্যা ও গণ–অভ্যুত্থানের কথাও এসেছে।

বিএনপি তাদের প্রস্তাবে ১৬টি দফার প্রতিটির শুরুতেই ‘যেহেতু’ শব্দ ব্যবহার করেছে। শেষ দফায় তারা নির্বাচনের কথা এনেছে। বলা হয়েছে, জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বৈষম্যহীন সমাজের অভিপ্রায় থেকে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

১৬ বছরের আন্দোলনের স্বীকৃতি চাওয়ার পেছনে যুক্তি কী

ছাত্র–জনতার ৩৬ দিনের আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপট রয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় বলে মনে করে বিএনপি।

দলটির নেতারা বলছেন, বিগত ১৬ বছরে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন–সংগ্রামে গুম–খুন, মামলা, জেল–জুলুমসহ নানা নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার হয়েছে। দলের তৃণমূলের নেতা–কর্মী থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতা কেউই রেহাই পাননি।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ একজন নেতা বলেন, তাঁদের দীর্ঘ এ আন্দোলন ও ত্যাগ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রেক্ষাপট তৈরি করে। একপর্যায়ে ছাত্ররা এগিয়ে এলে গণ–অভ্যুত্থান হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ের এ গণ–অভ্যুত্থানেও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এখন ঘোষণাপত্র করতে হলে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রামের স্বীকৃতি থাকতে হবে।

বিএনপি তাদের প্রস্তাবের খসড়া গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২–দলীয় জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ (এলডিপি) মিত্র দল ও জোটগুলোকে দিয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অল্প সময়ের মধ্যে জোটে বিএনপির প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে তাঁদের মতামত জানাবেন।

যদিও বিএনপির প্রস্তাব নিয়ে মিত্র দলগুলো এখনো নিজ নিজ দল বা জোটে আলোচনা করে মতামত জানানোর কথা বলছে, কিন্তু এসব দলের অনেক নেতা বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে একমত বলে মনে হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এ গণ–অভ্যুত্থানকে তাঁরা বিপ্লব হিসেবে দেখতে চান না। এ ছাড়া বর্তমান সংবিধানের ভিত্তিতেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। অন্যদিকে ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি কী হবে, এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁদের প্রস্তাবে তাঁরা আইনি সমস্যার কথা বলেননি। তবে তাঁরা মনে করেন, আইনি দিক নিয়ে অনেক আলোচনার প্রয়োজন হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ঘোষণাপত্রে জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের প্রধান্য থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো ঘোষণাপত্র হলে তাতে দেশের ইতিহাস–ঐতিহ্য, আন্দোলন–সংগ্রামের কথা তুলে ধরা হয়। এটাই যুক্তিসংগত। কারণ, জাতীয় ঐক্যের জন্য সমাজের প্রত্যেকের অনুভূতির স্বীকৃতি প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, বিভিন্ন ঘটনা ও নানামত সত্ত্বেও এখন সবার সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত। আর সহনশীলতার মাধ্যমে বিষয়গুলোতে একমত হওয়া সম্ভব।