আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর রাজনীতির দুই প্রধান শক্তি বিএনপি ও জামায়াত— উভয়ই মিত্র হিসেবে পাশে চাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে। তবে, রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ইসলামী আন্দোলন এখন পর্যন্ত কাউকে ‘চূড়ান্ত’ কথা দেয়নি। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের ব্যাপারে ‘সুর’ কিছুটা নরম করলেও আরও অনেক হিসাব-নিকাশ বাকি রয়েছে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইসলামী শক্তির পক্ষে যে ‘জোয়ার’ সৃষ্টি হয়েছে, কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা নষ্ট করতে চায় না চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন।
দলীয় সূত্র মতে, শর্ট-কাট কোনো পথে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার ইচ্ছা ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের নেই। দলের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে অন্য কোনো দল, সংগঠন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নীতি-আদর্শের মিল থাকলে তাদের সঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐক্য হতে পারে। অন্যথায় ‘একলা চল’ নীতিতে হাঁটবেন তারা।
এমন সিদ্ধান্ত থেকেই ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির ‘যুগপৎ’ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেনি ইসলামী আন্দোলন। আবার সরকারবিরোধী কোনো জোটেও ভেড়েনি চরমোনাই পীরের দলটি। বরং ‘জাতীয় সরকার’র অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় থেকে এককভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেছে দেশের তৃতীয় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ইসলামী আন্দোলন। শুধু তাই নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুর দিকে বড় রাজনৈতিক দলগুলো যখন ‘গা বাঁচিয়ে চলার নীতি’ গ্রহণ করেছিল, তখনও এককভাবে রাজপথে ছিল ইসলামী আন্দোলন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের নীতি ও আদর্শের ওপর অটুট থাকায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান সাংগঠনিক শক্তি, জনসমর্থন, ভোটব্যাংক বিবেচনায় নিয়ে ‘পুরোনো প্রতিপক্ষরা’ এখন রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে চরমোনাই পীরকে পাশে চাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) বরিশালে গিয়ে চরমোনাই পীরের দরবারে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
এ ঘটনার পরই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গুঞ্জন ওঠে- জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচন ও রাজনৈতিক জোট গঠনের পথে এগোচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। অধিকন্তু ‘৫ আগস্টের পর মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। তারা ইসলামের পক্ষে একটি বাক্স চায়। দেশের ইসলামী ও সমমনা দলগুলোকে কীভাবে কাছে এনে একটি বৃহত্তর সমঝোতা গড়ে তোলা যায় এবং নির্বাচনে একটি বাক্স দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে আমরা করাজ করছি’- মর্মে চরমোনাই পীরের দেওয়া বক্তব্যে ওই গুঞ্জন আরও ডালপালা মেলতে থাকে।
শুধু তাই নয়, প্রায় প্রতিদিনই বিএনপিকে ইঙ্গিত করে নানাধরনের নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা। সর্বশেষ রোববার (২৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘যারা রাজনীতিকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার বানাচ্ছে, তারাই অতীতে দেশকে দুর্নীতিতে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিল।’
এর পরই মূলত নড়েচড়ে বসে বিএনপি। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ও লিয়াঁজো কমিটির সদস্য বরকত উল্লাহ বুলুকে দায়ত্বি দেওয়া হয় ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মিটিং সেট করার জন্য। বিএনপির এই আগ্রহে ইতিবাচক সাড়া দেয় ইসলামী আন্দোলন। দ্রুততার সঙ্গে সোমবার (২৭ জানুয়ারি) পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের আমিরের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব।
বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়- দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি ও টাকা পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা না বলাসহ ১০টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ইসলামী আন্দোলন ও বিএনপি।
সূত্রমতে, কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ওই ‘গতানুগতিক’ বিষয়ের বাইরেও বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। যেগুলোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি দুই দলের দুই শীর্ষ নেতা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘দ্রুত নির্বাচন’ এবং পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি।
ইসলামী আন্দোলন শুরু থেকেই বলে আসছে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে করেই নির্বাচন আয়োজন করুক অন্তর্বর্তী সরকার। এক্ষেত্রে সেনাপ্রধান ঘোষিত দেড় বছরের (১৮ মাস) সময়সীমাকে তারা ‘যৌক্তিক সময়’ হিসেবে দেখছেন। কিন্ত, বিএনপি এত সময় দিতে রাজি নয় অন্তর্বর্তী সরকারকে। তারা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করার পক্ষে। কোনো অবস্থাতেই নির্বাচনকে আগামী বছর পর্যন্ত টেনে নিতে চান না বিএনপি নেতারা। সে কারণেই, বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করীম নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারকে আরও এক বছর সময় দিতে চাইলে তার বক্তব্য দ্রুত শেষ করার অনুরোধ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এ ছাড়া, পিআর পদ্ধতি নিয়েও দুই দলের অবস্থান দুই মেরুতে। বিএনপি কিছুতেই পিআর পদ্ধতি মেনে নেবে না। অন্যদিকে, পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন চায় ইসলামী আন্দোলন। এই ইস্যুতে জামায়াত এবং সিপিবিসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দলকে পাশে পাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গুরুত্বপূর্ণ এই দুইটি ইস্যু ছাড়াও যে দশটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ইসলামী আন্দোলন এবং বিএনপি, সেখানেও একটার সঙ্গে আরেকটা সাংঘর্ষিক অবস্থানে আছে। ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের তীর্যক সমালোচনা বন্ধে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা না বলার’ ব্যাপারে একমত হলেও ‘দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি ও টাকা পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির’ ব্যাপারটায় ঠেকে যাচ্ছে বিএনপি। কারণ, বিগত দিনে ক্ষমতায় থাকাকালীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন ও টাকা পাচারের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে দলটির অধিকাংশ অনেক নেতার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের পর এই বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলছে ইসলামী আন্দোলন।
সূত্রগুলো বলছেন, এসব বিষয় যোগ-বিয়োগ শেষে বিএনপির সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচন বা আন্দোলনের জোট হওয়ার সম্ভাবন খুবই কম। অন্যদিকে আকিদা ও আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে জামায়াতে ইসলামের সঙ্গেও ইসলামী আন্দোলনের জোটবদ্ধ সম্ভব নয়। তারপরও রাজনীতিতে যেহেতু শেষ বলে কিছু নেই, সেহেতু আগামী দিনে ইসলামী আন্দোলন কোন দিকে যাবে, সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ।
জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াতের আমির ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর বিএনপর মহাসচিব এসেছিলেন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। তাদের (বিএনপি) মনে কী ধরনের চিন্তা বা আকাঙ্ক্ষা আছে, সেটা তো আমরা জানি না। তবে, রাজনৈতিক দল হিসেবে সব দলের সঙ্গেই আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক বিদ্যামান। এটার মধ্যে আলাদা কিছু বা বিশেষ কিছু খোঁজার সুযোগ নেই।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা কথা বলছি, কথা বলব। তারই ধারাবাহিকতায় আজ ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বৈঠক শেষে আমাদের মহাসচিব সিদ্ধান্তগুলো গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন। এর বাইরে তেমন কিছু নেই।’