ঢাকার মতিঝিলের অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে খুন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। এ হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদার ওরফে মুসাকে ওমান থেকে ফিরিয়ে এনেছিল পুলিশ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পাঁচ মাস পর তিনি জামিনে মুক্ত হন। ২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্লবীতে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার নেতৃত্বে মুসা ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, পল্লবীতে খুনের শিকার ব্যক্তির নাম মঞ্জুরুল ইসলাম ওরফে বাবু (২৪)। অপরাধজগতে তিনি ‘ব্লেড বাবু’ নামে পরিচিত। তিনি পল্লবীতে আলোচিত শাহীন উদ্দিন হত্যা মামলার আসামি। বাবু খুনের পেছনেও রয়েছে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ। পল্লবী এলাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান ওরফে মামুন গ্রুপের সঙ্গে মুসা গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছে। খুনের শিকার বাবু ছিলেন মামুন গ্রুপের সদস্য। আধিপত্য বিস্তার ও অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে। দেশের বাইরে থেকে মিরপুর অঞ্চলের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণকারীদের একজন হলেন মামুন।
মঞ্জুরুল ইসলাম বাবু হত্যায় নাম আসা সুমন শিকদার ওরফে মুসা মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার আসামি। সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন।পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অহিদুজ্জামান
বাবু হত্যা মামলার শুরুতে তদন্ত করে পল্লবী থানা-পুলিশ। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মঞ্জুরুল ইসলাম বাবু হত্যায় নাম আসা সুমন শিকদার ওরফে মুসা মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার আসামি। সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
বাবু হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সোনাহর আলী শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার ঘটনায় মো. মুরাদ ও তুফান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা দুজনেই মুসা গ্রুপের সদস্য। এই হত্যায় জড়িত অনেকের নাম তাঁরা বলেছেন। এসব তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তবে অপরাধজগতের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বাবু আগে মুসার গ্রুপে ছিলেন। তবে জাহিদুল ইসলাম হত্যা মামলায় মুসা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামুনের দলে যোগ দেন। এতে বাবুর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন মুসা। ৩ জানুয়ারি সুমন শিকদার জামিনে মুক্ত হন। আর বাবু খুন হন ২০ জানুয়ারি।
মঞ্জুরুল ইসলাম বাবুর স্ত্রী রাবেয়া আক্তার মিম প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় বিরোধের জেরে তাঁর স্বামীকে মুঠোফোনে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। পাওনা টাকা নিয়ে এই বিরোধ তৈরি হয়েছিল বলে জানান তিনি। তাঁর স্বামী কোনো অপরাধী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলেও দাবি করেন।
টিপু হত্যা মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো তখন জানিয়েছিল, মুসার বিরুদ্ধে ঢাকার মতিঝিল, পল্লবীসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র মামলাসহ ১১টি মামলা রয়েছে। তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপের সদস্য। ২০১৬ সালে মতিঝিল এজিবি কলোনিতে যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি তিনি।
দুই নিয়ন্ত্রকের অপরাধনামা
মতিঝিল এলাকায় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ আধিপত্য ও অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু। সে সময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন ওরফে প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
টিপু হত্যা মামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে মুসার নাম উঠে আসে পুলিশের তদন্তে। টিপু হত্যা মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো তখন জানিয়েছিল, মুসার বিরুদ্ধে ঢাকার মতিঝিল, পল্লবীসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র মামলাসহ ১১টি মামলা রয়েছে। তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপের সদস্য। ২০১৬ সালে মতিঝিল এজিবি কলোনিতে যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি তিনি। টিপুকে হত্যা করতে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ও বিদেশে অবস্থানকারী একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন মুসা। তিনি মতিঝিলের ওই আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে ৯ লাখ টাকাও নেন। পরে টিপু হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি রিজভী হাসান হত্যা মামলার আসামিদের নির্দেশনা দেন। টিপু খুনের ১২ দিন আগে ২০২২ সালের ১২ মার্চ দুবাই চলে যান তিনি। টিপু হত্যার পর তিনি দুবাই থেকে ওমান চলে যান। ওমান পুলিশের সহায়তায় ওই বছরের ৯ জুন মুসাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অপরাধী বা শীর্ষ সন্ত্রাসী যে-ই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে ডিবি।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক
এদিকে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন সম্পর্কে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি মিরপুর এলাকার অপরাধজগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। ২০০১ সালে গ্রেপ্তার হন মামুন। পরে ২০০৪ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে অবস্থান করলেও মিরপুরের অপরাধজগতে তাঁর ব্যাপক প্রভাব ছিল। ভারতে বসেই একাধিক খুনে জড়িত হন তিনি। ২০০৮ সালে পল্লবীতে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জেরে নজরুল ইসলাম চৌধুরী (মন্টু) খুনে জড়ান তিনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মামুনের বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে খুন, চাঁদাবাজি, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার এবং ডাকাতিও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অধিকাংশ মামলা হয়েছে ঢাকার পল্লবী ও মোহাম্মদপুর থানায়।
২০০৮ সালে মামুন ভারতে অনুপ্রবেশ ও পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ১০ বছর সাজা ভোগ করে তিনি ২০১৮ সালে ভারতের কারাগার থেকে মুক্ত হন। তারপর মিরপুরের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহীম ও সাহাদাত হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেন। তিনি ভারতে বসেই মিরপুর অঞ্চলের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। ২০২০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মামুন ঢাকায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। কয়েক মাস পর জামিনে মুক্ত হয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যান মামুন।
পুলিশ বলছে, পল্লবীতে মঞ্জুরুল ইসলাম ওরফে বাবু হত্যাকাণ্ড অপরাধীদের পুনরায় সক্রিয় হওয়ার নজির। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধী বা শীর্ষ সন্ত্রাসী যে-ই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে ডিবি।
১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মামুনের বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে খুন, চাঁদাবাজি, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার এবং ডাকাতিও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অধিকাংশ মামলা হয়েছে ঢাকার পল্লবী ও মোহাম্মদপুর থানায়।