জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সারা দেশে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলাগুলোয় ঢালাওভাবে আসামি করার অভিযোগ রয়েছে। এসব মামলায় জুলাই আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন-এমন বহু নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, একশ্রেণির কুচক্রী ও আইনজীবী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য মামলায় তাদের নাম ঢুকিয়েছে। এ কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি বন্ধে ফৌজদারি কার্যবিধিতে ধারা ১৭৩-এর (ক) সংযোজন করেছে। যার উদ্দেশ্য হলো-তদন্তাধীন মামলাগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বাদ দেওয়া।
কিন্তু দেখা গেছে, এ ধারার সুযোগ নিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের পাশাপাশি জুলাই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা এবং ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসরদেরও মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
কয়েকটি অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সোমবার পর্যন্ত ঢাকার আদালতে ২৪৪ মামলায় ২২৭৭ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে মনিরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তিকে হত্যাচেষ্টার মামলায় ১৭ অক্টোবর আদালতে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দাখিল করেছেন মুগদা থানার এসআই আতিকুর রহমান। সেখানে এজাহারে নাম থাকা ২৩ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এর মধ্যে এজাহারনামীয় আসামি যাত্রাবাড়ী শ্রমিক লীগের সহসভাপতি অস্ত্রধারী ক্যাডার ও শুটার মিজানুর রহমান ফারাজী, যাত্রাবাড়ী যুবলীগের সহ-প্রচার সম্পাদক জামিল আহমেদ খান এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুলতান আহমেদ খানকেও অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেন, উল্লিখিত আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।
বংশাল থানার একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ২৫ অক্টোবর ১১ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দিয়েছেন এসআই সোহেল রানা। এর মধ্যে একজন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য নজরুল ইসলাম নজু। বাকিরা ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির (আনুয়ার হোসেন মঞ্জু) নেতা। তারা হলেন ভান্ডারিয়া উপজেলা পার্টির আতিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল তালুকদার (জেপি), পৌর ছাত্রসমাজের সভাপতি মাহবুব শরীফ শুভ (জেপি মঞ্জু), কায়কোবাদ (জেপি মঞ্জু), মেজবাহ উদ্দিন (জেপি মঞ্জু), ভান্ডারিয়া উপজেলা জাতীয় পার্টির (জেপি) আহ্বায়ক মহিবুল হোসেন মহিম, মামুন সরদার (জেপি মঞ্জু) ও শহিদুল ইসলাম (যুব সংহতি, জেপি মঞ্জু)।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এমন আরও অনেক অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে, যেখানে নিরপরাধ ব্যক্তিদের পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করা ব্যক্তিরা রয়েছেন। সেখানে একাধিক আসামির নামের পাশে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্মসম্পাদক, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা-এমন পদ-পদবি উল্লেখ রয়েছে। অথচ এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে সাক্ষ্য ও প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ঘটনাস্থলে উপস্থিতি, উসকানি দেওয়া কিংবা হামলার সময় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ আছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কিছু অসাধু তদন্ত কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী দোসরদের অব্যাহতির তালিকায় ঢোকাচ্ছেন। ফলে যে ১৭৩-এর (ক) ধারা নিরপরাধ মানুষকে রক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছিল, সেটিই এখন দোসরদের রক্ষাকবচে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি নতুন এক বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগ ও আদালত সূত্র জানায়, বিষয়টি নিয়ে আদালতে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে; যার কারণে এ ধরনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন আদালত আমলে না নিয়ে শুধু নথিভুক্ত করে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা কোর্টের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘অবিলম্বে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দাখিলের পুরো প্রক্রিয়া উচ্চপর্যায়ের তদারকির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যেসব তদন্ত কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হত্যা মামলার আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে জুলাই আন্দোলনের শহীদদের ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘নিরপরাধ মানুষকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে যদি খুনিদেরই আড়াল করা হয়, তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩-এর (ক) ধারা ইতিহাসে ন্যায়বিচারের নয়, বরং বিচারবিভ্রাটের নজির হিসাবে চিহ্নিত হবে।’
এ বিষয়ে ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি মিয়া মোহাম্মদ আশিস বিন হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘এ তথ্য আমরাও পেয়েছি যে, পদ-পদবি আছে, তাদের নামে ১৭৩ (ক) এসেছে। পরে যাচাই করে দেখা গেছে, একটা সময় হয়তো তাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য ছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই দল ত্যাগ করে জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন। তাছাড়া প্রতিবেদন দিলেই যে আদালত সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করছেন, এমন নয়। অনেক তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে আসার পর আদালত শুধু নোট রেখেছেন। এখন পর্যন্ত সেটার হ্যাঁ বা না কোনো আদেশই দেননি। কারও পদ-পদবি আছে-এমন প্রমাণ হাজির করতে পারেন, তাহলে যে কোনো মুহূর্তে বাতিল হবে।’
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘তদন্ত চলাকালে পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইন অনুযায়ী অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে অব্যাহতির সুপারিশ করা হচ্ছে। তবে এটা অন্তর্বর্তীকালীন সুপারিশ। যদি পরবর্তী সময়ে সুপারিশ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায় বা প্রমাণ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে চার্জশিটে তার নাম সংযুক্ত করা হবে।’
আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অব্যাহতির সুপারিশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটার যদি আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’