Image description

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর নির্মম হত্যাচেষ্টাকে কেন্দ্র করে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এ গুরুতর অপরাধের বিচার ও দোষীদের শনাক্ত করার দাবির পরিবর্তে ঘটনাটি নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, অভিযোগ ও ইঙ্গিতপূর্ণ রাজনীতি শুরু হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি।

গত শুক্রবার বেলা সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেল আরোহী সন্ত্রাসীরা ওসমান হাদিকে গুলি করে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইনকিলাব মঞ্চ জানিয়েছে, হাদির অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। এ ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে এবং সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জুলাই আন্দোলনের পক্ষের শক্তিগুলো তীব্র নিন্দা জানালেও পরে বিএনপি ও জামায়াত প্রকাশ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।

 

ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে উত্তেজনার সূত্রপাত

উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে ডাকসু ভিপি ও ছাত্রশিবির নেতা সাদিক কায়েমের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনের দলীয় মনোনীত প্রার্থী মির্জা আব্বাসের দিকে বিক্ষুব্ধ জনতার ‘তেড়ে’ যাওয়ার প্রেক্ষাপটে।

হাদির ওপর গুলি চালানোর প্রায় ২০ মিনিট পর সাদিক কায়েম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লিখেন—ওসমান হাদিকে গুলি করা হলো। চাঁদাবাজ ও গ্যাংস্টারদের কবল থেকে ঢাকা সিটিকে মুক্ত করতে অচিরেই আমাদের অভ্যুত্থান শুরু হবে। অভিযোগ ওঠে, ‘চাঁদাবাজ ও গ্যাংস্টার’ শব্দচয়নের মাধ্যমে বিএনপিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

হাদির ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর শুক্রবার রাতে জামায়াতে ইসলামীর আমির তার ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দেন সেটাও ইঙ্গিতপূর্ণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন—কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মতভিন্নতার কারণে এ ধরনের সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।

হাসপাতালে মির্জা আব্বাসকে ঘিরে ক্ষোভ

এদিকে আহত হাদিকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ওসমান হাদির সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস। তিনি সেখানে পৌঁছলে উপস্থিত জনতা ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেয় এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কেউ কেউ তার দিকে তেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে তাকে নিরাপত্তা দিয়ে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যান। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মির্জা আব্বাস সহানুভূতি জানাতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে পরিকল্পিতভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি ও মব তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, বিএনপির ওপর আঘাত এলে দল বসে থাকবে না। কীভাবে জবাব দিতে হয় বিএনপি তা জানে।

নয়াপল্টনের সমাবেশে পাল্টা বক্তব্য

পরদিন নয়াপল্টনে ওসমান হাদি ও চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে মির্জা আব্বাস বলেন, হাদিকে গুলি করার মাধ্যমে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এ হামলা পূর্বপরিকল্পিত এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে।

ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমের ফেসবুক পোস্টের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, হাদির গায়ে গুলি লেগেছে বেলা সোয়া ২টায়। ঠিক আড়াইটার সময় ফেসবুকে পোস্ট এলো, সবাই যে যেখানে আছো, ঐক্যবদ্ধ হও। কোনো একটা বাসায় যেতে হবে, ইট খুলে নিয়ে আসতে হবে। ভাবতে পারছেন ব্যাপারটা কত পরিকল্পিত।

হাসপাতালে পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সমাবেশে মির্জা আব্বাস বলেন, আমি ঢাকার রাজপথে আন্দোলন করে বড় হয়েছি। আমি ওই মুহূর্তে শান্ত থেকেছি, নীরব থেকেছি। সে সময় যদি আমার নির্দেশনা পেত, তাহলে তোমাদের তুলাধুনা করতে আমাদের ছেলেরা দেরি করত না।’

যারা আক্রমণাত্মক স্লোগান দিয়েছিল, তাদের কেউ ওসমান হাদির সমর্থক নয় বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে যারা এগুলো করেছে। এরা বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা ছিল। যারা সেখানে মব সৃষ্টি করেছিল, তারা চেয়েছিল হাদি ওখানেই মারা যাক।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি দাবি করেন, এটা সুপরিকল্পিত একটা বিষয়। হামলাকারী হিসেবে যাকে শনাক্ত করা হয়েছে, সে ছাত্রলীগের নেতা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভিপি সাদিক কায়েমের সঙ্গে একই টেবিলে চা খাচ্ছে। এখন এর বিচার কে করবে?

রিজভী একপর্যায়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের বরাতে একটি বক্তব্য উল্লেখ করেন, যেখানে হামলাকারীর সঙ্গে সাদিক কায়েমের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। পরে ডিএমপি এ বক্তব্যকে সম্পূর্ণ ভুয়া ও এআই দিয়ে তৈরি ছবি নির্ভর বলে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করে।

এ ঘটনার পর সাদিক কায়েম ও জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি তোলে। সাদিক কায়েম ফেসবুকে বলেন, আওয়ামী প্রোপাগান্ডা সেল কর্তৃক প্রচারিত এআই জেনারেটেড ছবিকে সত্য ধরে নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতা রুহুল কবীর রিজভী শরীফ ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টাকারীর সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে যে অপতথ্য ছড়িয়েছেন, তা কোনোভাবে প্রত্যাশিত দায়িত্বশীল আচরণ নয়। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে দল হিসেবে বিএনপি এবং ব্যক্তি রিজভী নিজেকে অপতথ্য ছড়ানোর অপরাধ থেকে দায়মুক্ত করার আহ্বান জানান।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জড়িয়ে ভিত্তিহীন বক্তব্য দেওয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারবিরোধী।

বক্তব্য প্রত্যাহার ও দুঃখ প্রকাশ

পরবর্তী সময়ে রাতে রুহুল কবির রিজভী তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করেন। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এআই-জেনারেটেড ছবি ও ভুয়া তথ্য যাচাই না করেই তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন। এ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।