দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দুর্নীতির মামলায় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এরপর শারীরিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু করে দেওয়া হয় তাকে। আদালতের আদেশে প্রায় আঠারো মাস পর কারামুক্ত হয়ে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাতে তারেক রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। সঙ্গে যান স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও একমাত্র কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমান। এর প্রায় দেড় যুগ পর, আগামী ২৫ ডিসেম্বর জননেতা হিসেবে দেশের মাটিতে পা রাখছেন তারেক রহমান। তার প্রত্যাবর্তন দিবসকে কেন্দ্র করে উজ্জীবিত বিএনপি; দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মাঝেও বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।
তারেক রহমানের আগমনকে শান্তিপূর্ণ করতে আগামীকাল সোমবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, তারেক রহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে ব্যাপক উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি তাকে বরণ করে নিতে নেওয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতি। গঠন করা হয়েছে কমিটিও। সেদিন ঢাকায় ব্যাপক লোকের সমাগম হবে বলে আশা করছেন দলটির নেতারা। তবে নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তাও রয়েছে। তার নিরাপত্তায় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) দেওয়ার জন্য সরকারকে দু-একদিনের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়ার কথা রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
দলীয় একাধিক সূত্র বলছে, তারেক রহমান দেশে ফিরে কোথায় উঠবেন এবং কোথায় অফিস করবেন, তাও চূড়ান্ত। এ ছাড়া খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। এই গাড়ি কেনার অনুমতি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে গাড়ি চলে এসেছে বলে দাবি সূত্রের।
দলীয় সূত্র আরও বলছে, গুলশান-২-এর ‘ফিরোজা’ ভবনে থাকেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া (এখন এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন)। এর পাশের বাড়িটি ১৯৮১ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর তৎকালীন সরকার তার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেয়। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গুলশান-২ অ্যাভিনিউ রোডের ওই বাড়ির নামজারি সম্পন্ন করে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের হাতে হস্তান্তর করে। দেশে ফিরে এ বাড়িতেই থাকার কথা রয়েছে তারেক রহমানের। চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়েই অফিস করবেন তারেক রহমান। এ জন্য তার বসার উপযোগী করেই কক্ষটি সাজানো হয়েছে। বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, তারেক রহমান লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আগে গুলশান-২-এর ফিরোজায় উঠবেন।
তারেক রহমান দেশে এলে রাজনীতিতে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এ নির্বাচনে জয় বিএনপির নয়; জয় হচ্ছে গণতন্ত্রের। বিএনপি হচ্ছে গণতন্ত্রের টর্চ বেয়ারার (মশালবাহী)। দেশের বাইরে হওয়া একটি জরিপের কথা উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ওই জরিপে মানুষ কেন বিএনপিকে ভোট দিতে চায়- সে প্রশ্নের উত্তরে জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম এসেছে। পাশাপাশি গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে বিএনপির নাম উঠে এসেছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা মনে করেন, গত ১৭ বছরে বিএনপিকে ভাঙার জন্য বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু একমাত্র তারেক রহমানের রাজনৈতিক কৌশল সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এ ঘোষণায় তুষ্ট বিএনপি। এ অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। যা বিএনপির নির্বাচনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে আসার মধ্য দিয়ে বিএনপির নির্বাচনের কাজ অর্ধেক শেষ হয়ে যাবে। প্রচারণা তো নির্বাচনের মূল বিষয়, সেদিন বিএনপির অর্ধেক প্রচারণাও হয়ে যাবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন এবং ঢাকা জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী বলেন, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আগমনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই।
২২ বছর বয়সে তারেক রহমান ১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলার গাবতলী থানা বিএনপির সদস্য হন। যদিও এর আগে থেকেই তিনি রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তারেক রহমান তাঁর মা খালেদা জিয়ার সহচর হিসেবে সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও মায়ের পাশাপাশি তারেক রহমান দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালান। এই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতির প্রথম সারিতে তাঁর সক্রিয় আগমন ঘটে। ২০০২ সালে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর পরই দেশব্যাপী দলের মাঠপর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। মূল সংগঠনসহ যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে তৃণমূল সভা আয়োজন করেন। মূলত এই জনসংযোগ কার্যক্রমের ফলে দলের নেতাকর্মীদের তরুণ অংশটির মধ্যে তারেক রহমান শুধু প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রীর সন্তানের পরিচিতি থেকে বেরিয়ে এসে দলের একজন দক্ষ সংগঠক ও সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর এই সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বিরোধী পক্ষ অপপ্রচার শুরু করে। তবে এর কোনোটারই ভিত্তি ছিল না।
অবশ্য এসব অপপ্রচারের দীর্ঘমেয়াদি ফলস্বরূপ ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়, নির্যাতনের শিকার হতে হয়; চিকিৎসার জন্য যেতে হয় লন্ডনে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যেও আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেন তারেক রহমান। তবে এর মধ্যেও তাঁকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চ আদালতের মাধ্যমে এক আদেশে তাঁর বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের আগ পর্যন্ত ছিল।
২০০৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে এবং ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলে তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে যুক্তরাজ্য থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সেখান থেকে সব সময় ভার্চুয়ালি দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন, নেতাকর্মীদের প্রতি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, তারেক রহমানের গায়ে কালিমা লেপন করতে বিগত ওয়ান-ইলেভেন থেকেই নানা অপচেষ্টা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ বিগত সরকারের নানা উইংও এ হীনকর্মে যুক্ত ছিল। বেশকিছু গণমাধ্যমও তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ন করতে নানা অপচেষ্টা চালিয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমাদের সময়কে বলেন, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তারেক রহমানকে হত্যার উদ্দেশে গ্রেপ্তার অবস্থায় নির্যাতন চালিয়েছে। তাঁর জনপ্রিয়তার লাগাম টানতে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ সামনে এনেছিল। দেশের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বিচার বিভাগ তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার করায় দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর পর ক্লিন ইমেজ নিয়ে আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশপ্রেমিক জননেতা হিসেবে দেশের মাটিতে পা রাখছেন তারেক রহমান।
গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি- দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, কোটি কোটি মানুষের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ প্রায় ১৮ বছর ধরে নির্বাসিত অবস্থায় বিদেশে রয়েছেন।... আগামী ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার মাটিতে এসে পৌঁছাবেন। সেদিন বড়দিনের বন্ধও রয়েছে। দলের পক্ষ থেকে আমরা তাঁর এই আগমনকে শুধু স্বাগতই নয়, আনন্দের সঙ্গে সমগ্র জাতিকে জানাচ্ছি। গণতন্ত্র উত্তরণের পথে যেসব বাধা সৃষ্টি হয়েছিল, আমরা মনে করি তারেক রহমান দেশে এসে পৌঁছালে সেসব বাধা দূর হয়ে যাবে।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে যুক্তরাজ্য থেকেই তারেক রহমান সব সময় ভার্চুয়ালি দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গত প্রায় ১৬ বছর বিএনপির বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা, খুন-গুম-নির্যাতন সত্ত্বেও তারেক রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার কারণে দল ছিল ঐক্যবদ্ধ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রয়াস চালাচ্ছেন। বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি ঐক্যের বার্তা দিচ্ছেন, পেশিশক্তির উত্থানের পরিবর্তে জনমানুষের পক্ষে কাজ করে জনসমর্থন সৃষ্টির বার্তা দিচ্ছেন। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপিরই প্রায় ৪ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিনি বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের প্রতি নৈতিক রাজনৈতিক চর্চার কঠোর বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এ উদ্যোগ ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিবেশের গুণগত পরিবর্তনের গোড়াপত্তন করবে বলে মনে করেন নেতারা।