Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নারী প্রার্থী উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দলীয় চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় নারীরা এক নতুন উদ্দীপনা ও শক্তি অনুভব করছেন।নারী প্রার্থীরা ভোটের মাঠে চমক দেখাতে প্রস্তুত।নির্বাচনি প্রচারে ইতোমধ্যে সবার নজর কেড়েছেন তারা। 

এবার প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সারা দেশে ১৩ টি আসনে নারী প্রার্থী দিয়েছে। আর তরুণদের নিয়ে গড়া নতুন রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে ১৪ জনকে ভোটের মাঠে নামিয়েছে।ঘোষিত ১২৫ আসনের মধ্যে এই সংখ্যক নারী প্রার্থী দিয়েছে দলটি; এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে পরের ধাপের মনোনয়নে।  

বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একা তিনটি আসনে ভোট করবেন। তিনি দিনাজপুর-৩, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

মানিকগঞ্জ-৩ আসনে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আফরোজা খান রিতা, সিলেট-২ আসনে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইলিয়াস আলীপত্নী তাহসিনা রুশদীর লুনা, ফরিদপুর-২ আসনে সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওয়াবেদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ আহমেদ। 

অন্য যেসব নারী মনোনয়ন পেয়েছেন তারা হলেন— নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন পুতুল, যশোর-২ আসনে মোছা. সাবিরা সুলতানা, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টু, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঢাকা-১৪ সানজিদা ইসলাম তুলি ও মাদারীপুর ১ নাদিরা মিঠু।

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘোষিত ১২৫টি আসনের মধ্যে ১৪টি আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বাকি আসনগুলোতে আরও অন্তত ১৫টিতে নারীকে মনোনয়ন দিতে পারে দলটি। 

ঢাকা মহানগরের ২০ আসনে বিএনপি একটিতে এবং এনসিপি চারটিতে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঢাকার এই পাঁচ আসন যেন পাঁচ নারীর জন্য বিশেষ ‘উপহার’।

এনসিপির হয়ে ঢাকা-৯ আসন থেকে লড়বেন ডা. তাসনিম জারা। এছাড়া ঢাকা-১৭ থেকে ডা. তাজনূভা জাবীন, ঢাকা-১২ থেকে নাহিদা সারওয়ার নিভা ও ঢাকা-২০ থেকে ইঞ্জিনিয়ার নাবিলা তাসনিদ নির্বাচন করবেন। অন্যদিকে ঢাকা-১৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হবেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি। ঢাকায় এ ৫ নারী ভোটের মাঠে লড়বেন পুরুষ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে তারা গণসংযোগ শুরু করেছেন।

সানজিদা ইসলাম তুলি যুগান্তরকে বলেন, ধানের শীষ উন্নয়নের প্রতীক। এ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছি। আমায় মনোনয়ন দেওয়ায় দলের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা দলের বিশেষ উপহার নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসনটি দলকে উপহার দিতে চাই। আসলে ক্ষমতার সমবণ্টন প্রয়োজন। এই মনোনয়নের মাধ্যমে সেই স্বপ্ন দেখতে পারি আমরা।

বিএনপির এই প্রার্থী বলেন, ঢাকার মিরপুর শাহ আলী ও দারুস সালাম এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৪ আসন। নির্বাচনি এলাকায় আমি প্রতিটি ভোটার তথা জনগণের হয়ে কাজ করতে চাই। বছরের পর বছর মানুষের কল্যাণেই কাজ করেছি। অধিকার আদায়ে রাত-দিন মাঠে ছিলাম। মানুষের হয়ে জীবন বিলিয়ে দিতে চাই। আশা করি, ভোটার ও সাধারণ মানুষ আমায় গ্রহণ করবেন। কারণ আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি কেবল তাদের জন্যই। এলাকার উন্নয়নে যা যা প্রয়োজন তা করব। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রত্যেকের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে শুনব।

বিএনপির নারী প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতিতে পারিবারিক ঐতিহ্য বহন করছেন। ফারজানা শারমিনের বাবা ফজলুর রহমান পটল ও আফরোজা খান রিতার বাবা হারুনুর রশিদ খান মুন্নু দুজনই ছিলেন সাবেক মন্ত্রী এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। শামা ওবায়েদের বাবা কেএম ওবায়দুর রহমান ছিলেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব। সানজিদা ইসলাম তুলি গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন এবং ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়ক। তাহসিনা রুশদীর লুনার স্বামী এম ইলিয়াস আলী ২০১২ সালে গুম হন। আর নায়াব ইউসুফের বাবা সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ।

নবমনোনীত মাদারীপুর-১ প্রার্থী নাদিরা মিঠু স্থানীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন সক্রিয়। তিনি শিবচর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মরহুম নাজমুল হুদা মিঠু চৌধুরীর স্ত্রী এবং জেলা বিএনপির সদস্য। আগে উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, এই আসনে ৩ নভেম্বর কামাল জামান মোল্লাকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও একদিন পর তা স্থগিত করা হয়েছিল।

এদিকে এনসিপির মনোনয়ন পাওয়া নারী প্রার্থীরাও চমক দেখানো অপেক্ষায়। ইঞ্জিনিয়ার নাবিলা তাসনিদ জানান, জীবনে বহুবার সুযোগ এসেছিল উন্নত দেশে গিয়ে জীবনকে রাঙিয়ে তোলার। কোনো সুযোগই গ্রহণ করেননি। কারণ দেশের মানুষ ও দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এনসিপির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনীতি করছি শুধু দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে। কোনো অবস্থায়ই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে রাজনীতিতে আসিনি। আমার নির্বাচনি এলাকার প্রতিটি পরিবারের দরজায় দরজায় গিয়ে ভোট চাইব। সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি, মানুষ নতুন কিছু চাইছে। মানুষ নতুনভাবে নতুন রাজনীতি নতুন প্রার্থীকে বেছে নিতে উৎসাহ ভরে অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে জয়ী হলে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নয়ন থেকে শুরু করে বাসিন্দাদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করব।

এনসিপির আরেক প্রার্থী ডা. তাজনূভা জাবীন গণ-অভ্যুত্থানে জীবনবাজি রেখে সামনের কাতারে ছিলেন। তিনি বলেন, সংসদে নারীদের অনুপস্থিতি তো কেবল নারীদের ইস্যু নয়। আমরা নতুন রাজনীতি নিয়ে এসেছি। মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করছি। স্বাস্থ্য শিক্ষা গার্হস্থ্য-সব ক্ষেত্রে চেহারা বদলে যাবে আমাদের রাজনীতির মধ্য দিয়ে। মানুষের মৌলিক চাহিদা বাস্তবায়নে আমরা শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করব।

তিনি আরও বলেন, আমরা অল্প সময়ের মধ্যে দল গঠন করেছি। ভোটের মাঠেও সময় কম পাচ্ছি। যতটুকু সময় রয়েছে, ভোটারদের কাছে যাব। নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি, সততা-নিষ্ঠার প্রমাণ দেব। প্রতিশ্রুতি দেব-এ রাজনীতি কেবল আপনাদের জন্য। মানুষের কল্যাণ-দেশের কল্যাণ করতেই রাজনীতিতে আসা। নারী শিশু উন্নয়নে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব। মাদক নির্মূলসহ নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করব।

এনসিপির প্রার্থী নাহিদা সারওয়ার নিভা বলেন, নতুন দল, নতুনভাবে গণসংযোগ-সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাছাড়া আমরাও রাজনীতিতে নতুন। তবে আমরা তথাকথিত জনপ্রতিনিধি হতে চাই না, মানুষের সেবক হতে চাই। মানুষের জন্য জীবনের মূল্যবান সময়টুকু দিতে চাই। আমরা হলফ করে বলতে পারি, জনগণের ভোটে আমরা জয়ী হয়ে, জনগণের সেবক হব। তিনি বলেন, ভোটাররা নতুনভাবে ভাবছে। নতুন রাজনীতি-নতুন জনপ্রতিনিধি পেতে অপেক্ষা করছে। আমরা যখন ভোটারদের কাছে যাচ্ছি, তারা বলছে, নতুন জনপ্রতিনিধি চান। তারা আমাদের গ্রহণ করছেন। আমরা এক পা এগোলে ভোটাররা ১০ পা এগোচ্ছেন।

ডা. তাসনিম জারা জানান, তার নির্বাচনি আসন ঢাকা-৯ সবুজবাগ, খিলগাঁও, মুগদা ও মান্ডা থানা নিয়ে গঠিত। নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি আইনে অনুমোদিত টাকার বাইরে এক টাকাও খরচ করবেন না। তিনি বলেন, রাজনীতি যেন হয় মানুষের জন্য, দেশের জন্য। শোনা যায়, একজন প্রার্থী ২০, ৫০, এমনকি ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেন। অথচ নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বলেন, মাত্র ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। ফলে প্রায় সবারই সংসদে যাওয়ার যাত্রাটাই শুরু হয় আইন ভাঙা ও মিথ্যা বলার মাধ্যমে। আমি এই অসততা ও মিথ্যার রাজনীতি করব না।